ভাববাদী যিহিষ্কেল বাবিলে নির্বাসিত যিহূদীদের নিশ্চয়তা দেন যে, তাদের উপরেই ঈশ্বরের আহ্বান ও প্রতিজ্ঞা রয়েছে, যিরূশালেমে থাকা যিহূদীদের উপর নয়। ঈশ্বর প্রতিজ্ঞা দেন যে, নির্বাসিত যিহূদীরা ঈশ্বরের প্রতি সাড়া দিতে থাকলে তিনি তাদের জন্য একটি চমৎকার পুনরুদ্ধার বাস্তবায়ন করবেন।
ভাববাদী যিহিষ্কেল হলেন পুরোহিত পরিবারের ছেলে। তিনি ৬২২ খ্রীষ্টপূর্বে, অর্থাৎ যিহূদা রাজ্যের শেষ দিনগুলোতে জন্ম গ্রহণ করেন এবং নিজের দেশ রাজনৈতিক ও আত্মিক ক্ষেত্রে খারাপ থেকে আরো খারাপ অবস্থায় পড়তে দেখেন। যখন ৬০৫ খ্রীষ্টপূর্বে বাবিল যিরূশালেমকে প্রথম বার দখল করে এবং অনেক লোকদের নির্বাসনে নিয়ে যায় তখন যিহিষ্কেলের বয়স ১৭ বছর ছিল। যিহূদা বাবিলের অধীনতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বলে, বাবিল ৫৯৭ খ্রীষ্টপূর্বে যিরূশালেমকে দ্বিতীয় বার দখল করে এবং আরো অনেক লোকদেরকে বাবিলে নির্বাসনে নেওয়া হয়। তাদের মধ্যে একজন হলেন যিহিষ্কেল। ৫৯২ খ্রীষ্টপূর্বে, যখন যিহিষ্কেলের বয়স ত্রিশ বছর ছিল এবং পুরোহিত হিসাবে ঈশ্বরের উপাসনা-ঘরে তার পরিচর্যা শুরু হওয়ার কথা ছিল, তখন তিনি নিজেকে বাবিলে খুঁজে পান, যা মন্দির থেকে অনেক দূরে।
ঈশ্বর যখন যিহিষ্কেলকে ভাববাদী হিসাবে আহ্বান করেন, যিরূশালেমে তখনও কিছু যিহূদী লোকসংখ্যা ছিল। বাবিল দু’বার যিরূশালেমকে দখল ও নির্বাসিত করলেও তারা এপর্যন্ত রেহাই পেয়েছিল। এই যিহূদীরা অহংকারী হয়ে চিন্তা করত যে, তারা নির্বাসিত যিহূদীদের চেয়ে ভাল এবং তারাই ঈশ্বরের দয়ার পাত্র। প্রকৃতপক্ষে তাদের আচরণ মন্দ: তারা ঈশ্বরের আরাধনার সাথে দেবতার পূজা মিশিয়ে ফেলেছে, এছাড়া তারা বিভিন্ন দেবতা পূজা করে এবং তাদের সমাজে অনেক অন্যায্যতা ও অনৈতিকতা চলতে থাকে। অপর পক্ষে নির্বাসিত যিহূদীরা নিরাশিত হয়ে মনে করে যে, ঈশ্বর তাদেরকে ত্যাগ করেছেন। তারা ঈশ্বরের ন্যায্যতা নিয়ে সন্দেহ করে: কেন তাদের নির্বাসিত করা হয়েছে যখন অন্য যিহূদীরা রেহাই পেয়েছে?
এই পরিস্থিতিতে যিহিষ্কেল একটি ভয়ংকর ও অদ্ভুত দর্শন দেখেন। তিনি ঈশ্বরকে এমন একটি সিংহাসনে বসে থাকতে দেখেন, যা চারটি জীবন্ত প্রাণী দিয়ে বহন করা হয় (যিহি ১)। দর্শনটির সবচেয়ে অবাক লাগার বিষয় হল: যিহিষ্কেল “সদাপ্রভুর মহিমা” বা ঈশ্বরের উপস্থিতি ঠিক কোথায় দেখেন। তিনি তা যিরূশালেমে ঈশ্বরের উপাসনা-ঘরে দেখেন না (যেখানে পুরোহিত হিসাবে যিহিষ্কেল ঈশ্বরের উপস্থিতি থাকার আশা করতেন), বরং তিনি সদাপ্রভুর মহিমা পরজাতি বাবিল দেশে দেখেন! কিছু দিন পরে যিহিষ্কেল আর একটি অদ্ভূত দর্শন পান: তিনি দর্শনে যিরূশালেমের উপাসনা-ঘর দেখেন, যেখানে যিহূদীরা বিভিন্ন দেবতার মূর্তিকে পূজা করে এবং পরবর্তীতে তিনি দেখেন কিভাবে ঈশ্বরের মহিমা যিরূশালেম উপাসনা-ঘর ছেড়ে চলে যাচ্ছে (যিহি ৮-১১)!
এই দু’টি দর্শন যিহূদীদের কাছে যিহিষ্কেলের সংবাদে পরিণত হয়: ঈশ্বরের উপস্থিতি, দয়া ও আহ্বান যিরূশালেমের সেই একগুঁয়ে দেবতাপূজারী যিহূদীদের সঙ্গে আর নয় (তারা আর বেশি দিন বাঁচবে না), বরং নির্বাসিত যিহূদীদের সঙ্গেই, যারা ঈশ্বরের বিচার ও সংশোধন মেনে নিয়ে এখন বাবিলে বাস করছে। যিহিষ্কেল তাই নির্বাসিত যিহূদীদের উৎসাহদানকারী হয়ে যান: ঈশ্বর তাদের পরিত্যাগ করেন নি বরং তিনি চান যেন তারা তাঁর সংশোধন মেনে নিয়ে নির্বাসনে ঈশ্বরের ভক্তিতে জীবন-যাপন করে এবং বিশ্বাস ধরে রাখে যে, ঈশ্বর তাঁর প্রতিজ্ঞা অনুসারে যিহূদীদের অবশ্যই একদিন নির্বাসন থেকে নিজের দেশে ফিরে যাওয়ার সুযোগ দেবেন। ঈশ্বরের আশীর্বাদ ও আহ্বান যিরূশালেমে থাকা যিহূদীদের উপরে নয় বরং বাবিলে নির্বাসিত যিহূদীদের উপর। ঈশ্বর তাদেরকে নির্বাসনে নিরাপত্তায় রাখবেন এবং তাদের নিয়ে এক দিন নতুন কিছু শুরু করবেন। যিহিষ্কেল যেমন ঈশ্বরের এই বাণী নির্বাসিত যিহূদীদের কাছে প্রচার করেন, যিরমিয় ঠিক সেই একই বাণী যিরূশালেমে থাকা যিহূদীদের কাছেও প্রচার করেন (যিরমিয় ২৯:৫-১৪, ৩৮:১৭-১৮)।
ঈশ্বরের এই বাণী যিহিষ্কেল ৫৯২ থেকে ৫৮৭ খ্রীষ্টপূর্ব পর্যন্ত নির্বাসিত যিহূদীদের কাছে বলতে থাকেন। তিনি অনেক রূপকের ব্যবহার দ্বারা, কাহিনী বলা দ্বারা এবং নাটকীয় ভাববাদী মূলক চিহ্ন দ্বারা তা করেন (যিহি ৪-২৪ অধ্যায়)। ঈশ্বর যিহিষ্কেলের কথা বলার উপরে কঠোর সীমিতকরণ স্থাপন করেন, যিহিষ্কেল ঈশ্বরের বাণী দেওয়া ছাড়া সম্পূর্ণ বোবা হয়ে যান (যিহি ৩:২২-২৭)। এই সীমিতকরণ কয়েকটি বছর থাকে, যা দ্বারা ঈশ্বর যিহিষ্কেলের বাণীর উপর – সেই অল্প সময় যখন তিনি কথা বলবেন – তা আরো ভারী, অর্থপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ করে দেন। যিহিষ্কেলের নিরব অবস্থা তার কথা বলার চেয়ে শক্তিশালী একটি সংবাদ হয়ে দাঁড়ায়। ৫৮৭ খ্রীষ্টপূর্বে যখন বাবিলীয়েরা তৃতীয় বার যিরূশালেমকে ঘেরাও করতে শুরু করে, তখন ঈশ্বর যিহিষ্কেলকে সম্পূর্ণ বোবা করে দেন। সব বাণী বলা হয়েছে, এখন বাণীর পূর্ণতা পর্যন্ত, অর্থাৎ যিরূশালেমের ধ্বংস পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই (যিহি ২৪:২৫-২৭)। অবশেষে যখন যিরূশালেম থেকে একজন সংবাদদাতা এসে বলে যে, যিরূশালেম ধ্বংস করা হয়েছে, তখন যিহিষ্কেল কথা বলার ক্ষমতা আবার ফিরে পান (যিহি ৩৩:২১-২২)। তার সব ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ হয়েছে, যিহিষ্কেল ঈশ্বরের সত্যিকার ভাববাদী হিসাবে প্রমাণিত হয়েছেন (২য় বিবরণ ১৮:২০-২২)।
ঈশ্বর যিহিষ্কেলকে একটি দ্বিতীয় আহ্বান দেন (যিহি ৩৩:১-২০) কিন্তু এইবার আশা-দাতা হিসাবে। এখন থেকে যিহিষ্কেল ঈশ্বরের অদ্ভূত উদ্ধারের প্রতিজ্ঞার প্রচারক হয়ে যান, আশ্চর্য ও অবিশ্বাস্য একটি উদ্ধার, যা কেউ পাওয়া যোগ্য নয়।
ভাববাদী যিরমিয় তার আগে যেমন বলেছিলেন, ঠিক তেমনি যিহিষ্কেলও ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞা ঘোষণা করেন যে, ঈশ্বর অবশ্যই যিহূদীদের নির্বাসন থেকে নিজের দেশে ফেরার সুযোগ দেবেন এবং একটি চমৎকার পুনরুদ্ধার ঘটাবেন। সরুব্বাবিল, ইষ্রা ও নহিমিয়ের নেতৃত্বে ৫৩৬, ৪৫৮ ও ৪৪৪ খ্রীষ্টপূর্বে ঠিক তাই ঘটে।
কিন্তু যিহিষ্কেলের পুনরুদ্ধার বাণীগুলো এমন চমৎকার যা ইঙ্গিত দেয় যে, এই ঐতিহাসিক পূর্ণতার উর্ধ্বে আরো বড় কিছু বুঝানো হচ্ছে। তিনি বলেন যে, ঈশ্বর ইস্রায়েলকে তাঁর পছন্দের মত একজন ‘মেষপালক’ দেবেন, যা পরবর্তীতে যীশুতে পূর্ণ হয়। যিহিষ্কেল একটি আশ্চর্য পুনরুদ্ধারের বর্ণনা দেন: যা মারা গেছে আবার জীবিত করে তোলা হবে (যিহি ৩৭); মন্দ, হিংস্র ও দমনকারী মানুষকে পরাজিত করা হবে (যিহি ৩৮-৩৯); একটি নিখুঁত উপসনা-ঘর নির্মাণ করা হবে (যিহি ৪০-৪৩); একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ স্থাপন করা হবে (যিহি ৪৪-৪৮) এবং ঈশ্বরের উপস্থিতি থেকে একটি নদী বয়ে যাবে, যা জীবন, যোগান ও সুস্থতা নিয়ে আসবে। যিহিষ্কেলের দর্শন ও ছবিগুলো এমন মহান যে, সেগুলো প্রকাশিত বাক্য পুস্তকে আবার পাওয়া যায়, যখন স্বর্গের অর্থাৎ সব কিছুর উপর ঈশ্বরের চমৎকার রাজত্বের বর্ণনা করা হয় (প্রকাশিত ২১-২২)।
পুস্তকের লেখক
লেখক নিজের পরিচয় এভাবে দেন: “বুষির ছেলে পুরোহিত যিহিষ্কেল” (যিহি ১:৩)। তার একজন স্ত্রী আছে, তার “নয়নের প্রীতিপাত্রকে” (কেরী) যিনি পুস্তকে বর্ণিত ঘটনার সময়ে মারা যান (যিহি ২৪:১৫,১৮)। ঈশ্বর যিহিষ্কেলকে তার স্ত্রীর জন্য প্রকাশ্যে শোক করতে নিষেধ করেন। তার এই আচরণ যিহূদীদের জন্য একটি ভাববাদীমূলক চিহ্ন হিসাবে দাঁড়ায়।
যিহিষ্কেল যখন ঈশ্বরের আহ্বান পান তখন তার বয়স ৩০ বছর এবং তিনি কবার নদীর পাড়ে তেল-আবীব নামে একটি জায়গায় নির্বাসিত যিহূদীদের মধ্যে বাস করেন (যিহি ১:১, ৩:১৫)। যিহিষ্কেল আহ্বান পান যিহূদার “রাজা যিহোয়াখীনের বন্দী হবার ৫ম বছর”এ, অর্থাৎ ৫৯২ খ্রীষ্টপূর্বে। যিহিষ্কেলের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে একটি সময় তালিকা তৈরি করা যায়:
- ৬২২ খ্রীঃপূঃ যিহিষ্কেলের জন্ম যুবক যিরমিয় ৫ বছর ধরে ভাববাণী দিচ্ছেন, রাজা যোশিয় আইন-কানুন পুনরাবিষ্কার করেন, যার ফলে একটি আত্মিক জাগরণ ঘটে (২ রাজা ২২)।
- ৬০৯ খ্রীঃপূঃ ১৩ বছর বয়স রাজা যোশিয় দুঃখজনকভাবে যুদ্ধে মারা যান। যিহূদা দেবতা পূজায় ফিরে গিয়ে সব ক্ষেত্রে তাড়াতাড়ি খারাপের দিকে চলে যায়।
- ৬০৫ খ্রীঃপূঃ ১৭ বছর বয়স বাবিলীয়েরা যিরূশালেমকে প্রথম বার দখল করে এবং অনেক যিহূদীদের নির্বাসনে নিয়ে যায়। যিহিষ্কেলকে নেওয়া হয় না বলে তিনি যিরূশালেমে রয়ে যান।
- ৫৯৭ খ্রীঃপূঃ ২৫ বছর বয়স বাবিলীয়েরা যিরূশালেমকে পুনরায় দখল করে এবং আরো অনেক যিহূদীদের নির্বাসিত করে, তাদের মধ্যে একজন হলেন যিহিষ্কেল।
- ৫৯২ খ্রীঃপূঃ ৩০ বছর বয়স এই বয়সে যিহিষ্কেলের পুরোহিত হিসাবে পরিচর্যা শুরু করা উচিত ছিল (গণনা ৪:৩, ২ বংশা ২৩:৩), কিন্তু তিনি নিজেকে উপাসনা-ঘর থেকে অনেক দূরের একটি পরজাতি দেশে খুঁজে পান।
যিহিষ্কেল কি তার জীবন নিয়ে নিরাশিত? তিনি কি যিরূশালেমে যাওয়ার চিন্তা করেন? তার মনে কি হিংসা বা ক্ষোভ চলছে, কারণ তিনি এভাবে বাদ পড়েছেন? অথবা তিনি কি পুরোহিতদের দুর্নীতি দেখে বেশি আগ্রহী নন? মজার বিষয় হল যে, যে বছরে যিহিষ্কেলকে তার পুরোহিত ভূমিকা পালন করতে শুরু করার কথা ছিল, ঠিক সেই বছরে ঈশ্বর তাকে একটি শক্তিশালী দর্শন দেন এবং তাকে ভাববাদী হিসাবে আহ্বান করেন। এপর্যন্ত ইস্রায়েলের ভাববাদীরা বেশিরভাগ ইস্রায়েলের ভূমিতেই আহ্বান পেয়েছেন এবং তারা ইস্রায়েলের মধ্যেই পরিচর্যাও করেছেন, কিন্তু দানিয়েল ও যিহিষ্কেল (এবং যোনা) ইস্রায়েলের সীমানার বাইরে আহ্বান পান এবং পরিচর্যা করেন।
- ৫৮৬ খ্রীঃপূঃ ৩৬ বছর বয়স বাবিলীয়দের দ্বারা যিরূশালেমের তৃতীয় দখলের পরে তারা শহর ও সদাপ্রভুর উপসনা-ঘর সম্পূর্ণ ধ্বংস করে। বেদীতে উৎসর্গ এবং বাকি পুরোহিতদের পরিচর্যা বন্ধ হয়ে যায়। হয়তো এই ঘটনা খারাপ লাগলেও যিহিষ্কেলকে আরো নিশ্চয়তা দেয়।
- ৫৭২ খ্রীঃপূঃ ৫০ বছর বয়স যিহিষ্কেলের শেষ ভাববাণী যার তারিখ দেওয়া আছে (যিহি ২৯:১৭)। আইন-কানুন অনুসারে পুরোহিতেরা ৫০ বছর বয়সে অবসরে যায় (গণনা ৪:২-৩)। পুরোহিত যিহিষ্কেলের বিষয়ে ঈশ্বর সময় খুব রক্ষা করেন, চিন্তা করা যায়।
যিহিষ্কেল ভাববাদী হিসাবে লোকদের কাছ থেকে বেশি ভাল সাড়া পান না (যিহি ৩:৭-১১, ২০:৪৯); ঈশ্বর তাকে অনেক কঠিন নাটকীয় ভাববাদীমূলক কাজ করতে বলেন (যেমন যিহি ৪ অধ্যায়); তার কথা বলার ক্ষমতা সীমিত করে দেন এবং তার স্ত্রীর মৃত্যুর সময়ে শোক প্রকাশ করতে নিষেধ করেন (যিহি ২৪:১৫-২৭)। তবুও যিহিষ্কেল অভিযোগ না করে প্রত্যেক ক্ষেত্রে বাধ্য হন। যখন ঈশ্বর তাকে মানুষের পায়খানা দিয়ে রান্না করতে বলেন, শুধু তখনই যিহিষ্কেল ঈশ্বরকে নিজের বিষয়ে অনুরোধ করেন (যিহি ৪:১৪)।
যিহিষ্কেলের সমকালীন ভাববাদীরা হলেন যিরমিয়, যিনি যিরূশালেমে ঈশ্বরের বাণী দেন এবং ভাববাদী দানিয়েল, যিনি বাবিল সরকারের উঁচু পদের একজন কর্মকর্তা, যিনি বেশ কয়েকবার বাবিল রাজাদেরকে বাণী দেন।
যিহিষ্কেলের শ্রোতারা ও পাঠকেরা
ভাববাদী যিহিষ্কেলের শ্রোতারা হল বাবিলে নির্বাসিত যিহূদী, যাদের ৬০৫ এবং ৫৯৭ খ্রীষ্টপূর্বে বাবিলে নেওয়া হয়েছিল (যিহি ৩:১১)। তার বেশ পরে, যে সব যিহূদীদের ৫৮৬ খ্রীষ্টাপূর্বে নির্বাসিত করা হয়, তারাও যিহিষ্কেলের শ্রোতা হয়ে যায়। যিহিষ্কেল পুস্তকের পাঠকেরা হল দ্বিতীয় প্রজন্মের যিহূদী, অর্থাৎ বাবিলে জন্ম নেওয়া যিহূদীরা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের যিহূদীরা।
যিহিষ্কেল যখন ভাববাণী বলতে শুরু করেন তখন যিরূশালেমে কিছু যিহূদী রয়ে গেছে যারা এপর্যন্ত নির্বাসন থেকে রেহাই পেয়েছে, যদিও বাবিল যিরূশালেমকে ইতিমধ্যে দু’বার দখল করেছে। যিরূশালেমের যিহূদীরা অহংকারী হয়ে উঠেছে এই কথা মনে করে যে, তারা ঈশ্বরের প্রিয় এবং নির্বাসিত যিহূদীদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। তবুও তারা খোলামেলাভাবে দেবতা পূজা করে, সদাপ্রভুর অনুশীলন ও পরজাতি ধর্মকর্ম মিশিয়ে ফেলে, সামাজিক অন্যায়কে ছোট বিষয় মনে করে এবং যিরমিয়ের বাক্য অগ্রাহ্য করে (যিহি ২:৬-৭)। তারা বিশ্বাস করে যে, যিরূশালেম কখনও ধ্বংস হবে না, কারণ তার মধ্যে সদাপ্রভুর উপাসনা-ঘর আছে। তারা দেবতা পূজাও করে, সদাপ্রভুর নামে উৎসর্গও করে এবং এগুলো মিশিয়ে ফেলা সমস্যা মনে করে না। তাদের ধার্মিকতাই সব মিথ্যা এবং তাদের মধ্যে ঈশ্বরের জ্ঞান নেই। রাজারা, রাজকর্মচারীরা, প্রাচীনেরা, পুরোহিত ও ভাববাদীরা তারা সবাই দুর্নীতিগ্রস্ত (যিহি ২২:৬-১২, ৮:১৩-১৪) এবং তারা লোকদেরকে ভুল পথে পরিচালনা করেন (যিহি ১১, ৩৪)।
অপর পক্ষে নির্বাসিত যিহূদীরা নিজেদেরকে অসহায় মনে করে এই কথা চিন্তা করে যে, ঈশ্বর তাদেরকে ত্যাগ করেছেন এবং শুধু তাদেরকেই শাস্তি দিয়েছেন। তারা মনে করে যে, ঈশ্বর যিরূশালেমকে এবং যিরূশালেমে থাকা যিহূদীদের বাবিলের হাত থেকে রক্ষা করবেন। ফলে তারা এই মিথ্যা আশা ধরে রাখে যে, তারা শীঘ্রই যিরূশালেমে ফিরে যেতে পারবে। তারা হৃদয়ে ক্ষোভ ধরে রাখে এই কথা মনে করে যে, ঈশ্বর শুধু তাদেরকেই বিচার করেছেন এবং তারা নিজেকে যিরূশালেমের যিহূদীদের চেয়ে নীচু মনে করে। তারা নিজেদেরকে উৎসর্গ পদ্ধতি ও ঈশ্বরের উপস্থিতি থেকে বঞ্চিত লোক মনে করে। এই ভুল চিন্তার বিপরীতে যিরমিয় তাদের উৎসাহিত করেন, যেন তারা নির্বাসনকে ঈশ্বরের বিচার হিসাবে মেনে নেয় এবং নির্বাসনে স্বক্রিয়ভাবে জীবন-যাপন করে, নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করে, ব্যবসা করে ও সন্তান নেয়, যদিও চারিদিকে দেবতা পূজা চলছে (যির ১৯:১-২৩)। প্রকৃতপক্ষে বাবিলীয়েরা নির্বাসিতদেরকে বেশ কিছু স্বাধীনতা দিয়েছিল (যেমন ঘর-বাড়ি ও ব্যবসা করা) যতক্ষণ পর্যন্ত তারা শান্তিপূর্ণভাবে জীবন-যাপন করে। বেশিরভাগ নির্বাসিতরা বাবিলের একটি উর্বর এলাকায় বাস করত।
৫৮৬ খ্রীষ্টপূর্বে যখন যিরূশালেম ও উপাসনা-ঘর সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয় এবং যে অল্প সংখ্যক যিহূদীরা বেঁচে যায়, তাদেরকেও বাবিলে নির্বাসিত করা হয় (যিহি ৩৩:২১-২২) তখন এই সব অহংকার ও মিথ্যা বিশ্বাসগুলো ভেঙ্গে যায়।
প্রথম ও দ্বিতীয় দলের নির্বাসিতদের কিছু উক্তি দেখে বুঝা যায়, তাদের চিন্তা কি ছিল: “তবুও তোমরা বলছ ‘বাবার দোষের জন্য কেন ছেলে শাস্তি পাবে না?’” (যিহিষ্কেল ১৮:১৯), অর্থাৎ তারা মনে করে যে, পূর্বপুরুষদের পাপের কারণে তাদের উপর ঈশ্বরের শাস্তি নেমে এসেছে। “তবুও তোমরা বলছ, ‘প্রভুর পথ ঠিক নয়’” (যিহি ১৮:২৫), অর্থাৎ তারা অভিযোগ করে যে, তাদের উপরে কেন শাস্তি নেমে এসেছে কিন্তু যিরূশালেমে থাকা যিহূদীদেরকে কোন শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে না? “তোমরা বলে থাক যে, তোমরা জগতের অন্যান্য জাতির লোকদের মত হতে চাও যারা কাঠ ও পাথরের পূজা করে” (যিহিষ্কেল ২০:৩২), অর্থাৎ তাদের নালিশ এই যে, ঈশ্বরকে আরাধনা করার পরেও যেহেতু তারা কোন লাভ বা সুরক্ষা পায় নি, তাই দেবতাপূজাও করা যাবে। “আমাদের হাড়গুলো শুকিয়ে গেছে আর আমাদের আশাও চলে গেছে; আমরা মরে গেছি” (যিহিষ্কেল ৩৭:১১), অর্থাৎ নিজের জাতির আহ্বান বা ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের আর আশা নেই। এই ধরণের ভুল চিন্তাগুলো ভাঙ্গার জন্য যিহিষ্কেল অত্যন্ত চেষ্টা করেন।
ঐতিহাসিক পরিস্থিতি
২ রাজা ২২-২৫ এবং ২ বংশা ৩৪-৩৬ অধ্যায়ে যিহিষ্কেলের সময়ে ঐতিহাসিক পরিস্থিতির একটি বর্ণনা পাওয়া যায়। নিচে একটি সারাংশ দেওয়া হয়েছে:
- ৬০৫ খ্রীঃপূঃ কর্কমিশ শহরে যুদ্ধ: বাবিলের নতুন নেতা নবূখদনিৎসর আসিরিয়া ও মিসরের জোটকে পরাজিত করেন। বাবিল আসিরিয়া সাম্রাজ্যের এলাকাগুলো নিজের ক্ষমতায় এনে, দক্ষিণ দিকে দখল করতে করতে মিসর দেশের দিকে আগায়। বেশ কয়েকটি জাতি এবং তাদের মধ্যে যিহূদাকেও পরাজিত করা হয় এবং যিহূদীদের প্রথম দল নির্বাসনে নেওয়া হয়। তাদের মধ্যে আছেন দানিয়েল ও তার তিনজন বন্ধু। বাবিল যোশিয়ের দ্বিতীয় ছেলে যিহোয়াকীমকে বাবিলের অধীনে যিহূদার রাজা হিসাবে স্থাপন করে।
- ৬০১ খ্রীঃপূঃ যিহোয়াকীম বাবিলের অধীনতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন।
- ৫৯৭ খ্রীঃপূঃ বাবিল বিদ্রোহী রাজা যিহোয়াকীমের যিহূদাকে দখল করে যিরূশালেমকে ঘেরাও করেন। যিহোয়াকীম মারা যান এবং তার ছেলে যিহোয়াখীন সিংহাসনে ওঠেন। তিনি বাবিলের কাছে আত্ম-সমর্পণ করেন এবং এভাবে বাবিল দ্বিতীয় বার যিরূশালেম নিজের অধীনে আনে। রাজা যিহোয়াখীন এবং বেশ কয়েজ হাজার যিহূদীদেরকে নির্বাসনে নেওয়া হয় (২ রাজা ২৪:১৪), তাদের মধ্যে একজন হলেন যিহিষ্কেল। বাবিল যোশিয়ের তৃতীয় ছেলে সিদিকিয়কে বাবিলের অধীনের যিহূদার রাজা হিসাবে স্থাপন করে।
- ৫৯? খ্রীঃপূঃ যদিও যিরমিয় তাকে বার বার সাবধান করেন তবুও রাজা সিদিকিয় বাবিলের অধীনতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন।
- ৫৮৮ খ্রীঃপূঃ বাবিল তৃতীয় বার এসে বিদ্রোহী সিদিকিয়ের যিহূদাকে দখল করে যিরূশালেমকে ঘেরাও করেন।
- ৫৮৬ খ্রীঃপূঃ বাবিল যিরূশালেমের দেওয়াল ভেঙ্গে শহরটি ও সঙ্গে সদাপ্রভুর উপাসনা-ঘর সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে। যে অল্প কয়েকজন যিহূদী যুদ্ধ ও ঘেরাওয়ের পরেও বেঁচে ছিল, তাদেরকে বাবিলে নির্বাসনে নেওয়া হয় (যিহি ৩৩:২১)।
যিহিষ্কেলের অদ্ভূত দর্শন যিহিষ্কেল ১-৩
যখন ত্রিশ বছর বয়সী যিহিষ্কেল নিজেকে একটি পরজাতি দেশে এবং উপাসনা-ঘর বিহীন পুরোহিত হিসাবে খুঁজে পান, তখন ঈশ্বর একটি ভয়ংকর ও চমৎকার দর্শনে তার সঙ্গে সাক্ষাত করেন। তিনি একটি দর্শনে তুফান, অন্ধকার মেঘ এবং বিদ্যুৎ চমাকনোর মত উজ্জলতার মাঝখানে বিছানো কিছুর উপরে একটি ভ্রাম্যমান সিংহাসনে বসে থাকা স্বয়ং ঈশ্বরকেই দেখতে পান (যিহিষ্কেল ১)! তিনি খুব সাবধানভাবে দর্শনের বর্ণনা দেন: “যা দেখা গেল তা ছিল সদাপ্রভুর মহিমার মত” (ইংরেজি অনুবাদে “I saw… the appearance of the likeness of the glory of the LORD”)। যিহিষ্কেল এই শক্তিশালী দর্শনের সামনে উবুড় হয়ে পড়েন (যিহিষ্কেল ১:২৮)।
এই অদ্ভূত দর্শনের সবচেয়ে অদ্ভূত বিষয় হল যে, তিনি ঈশ্বরের মহিমা ও উপস্থিতি যিরূশালেমের উপাসনা-ঘরে দেখেন না (যেখানে থাকার কথা ছিল) বরং নির্বাসিত হিসাবে তিনি বাবিলে, অর্থাৎ একটি পরজাতি দেশে ঈশ্বরের উপস্থিতি দেখেন। এই বিষয়টি তার ভাববাণীর একটি বড় সংবাদ: ঈশ্বর বাবিলে আছেন, নির্বাসিতদের সঙ্গে সঙ্গেই আছেন, তিনি তাদের ত্যাগ করেন নি এবং তারা ঈশ্বরের সুরক্ষা বিহীন বা আশা বিহীন নয়।
যিহিষ্কেল শুধমাত্র যে ঈশ্বরের একটি দর্শন দেখেন, তা নয়, সেই সাথে ঈশ্বর এই দর্শনে তার কাছে কথা বলতেও শুরু করেন: “হে মানুষের সন্তান, আমি তোমাকে ইস্রায়েলীয়দের কাছে, অর্থাৎ যারা আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে সেই বিদ্রোহী জাতির কাছে পাঠাচ্ছি; তারা এবং তাদের পূর্বপুরুষেরা আজ পর্যন্ত আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে আসছে … তারা একগুঁয়ে ও জেদী” (যিহিষ্কেল ২:৩-৪)। পুস্তকটিতে ঈশ্বর অনেক বার যিহিষ্কেলকে “মানুষের সন্তান” বা “মনুষ্যপুত্র” বলে ডাকেন, যা মানুষের জন্য সম্মানের পদবী কিন্তু সেই সাথে মানুষের মরণশীলতাকেও স্মরণ করিয়ে দেয়। যীশু প্রায়ই এই শব্দটি দিয়ে নিজেকে বর্ণনা করেন (লূক সুসমাচার দেখুন)।
ঈশ্বর যিহিষ্কেলকে খুব পরিষ্কারভাবে জানান যে, তার পরিচর্যা কেমন হবে এবং তাকে কত অগ্রাহ্যের সম্মুখীন হতে হবে: “তারা বিদ্রোহী বলে আমার কথা না-ও শুনতে পারে, কিন্তু তারা শুনুক বা না শুনুক তুমি তাদের কাছে আমার কথাগুলো বলবে” (যিহিষ্কেল ২:৭)। অনেক বছর পরে যখন ঈশ্বর তাকে পুনরায় আহ্বান করেন, তখন তিনি বলেন: “ধর, পাহারাদার … সে দেশের বিরুদ্ধে সৈন্যদল আসতে দেখে লোকদের সতর্ক করবার জন্য তূরী বাজাল। তখন যদি কেউ তূরীর আওয়াজ শুনেও সতর্ক না হয় আর সৈন্যেরা এসে তাকে মেরে ফেলে তবে তার মৃত্যুর জন্য সে নিজেই দায়ী থাকবে। … কিন্তু ধর, সেই পাহারাদার সৈন্যদলকে আসতে দেখেও লোকদের সতর্ক করবার জন্য তূরী বাজাল না … তার মৃত্যুর জন্য আমি সেই পাহারাদারকে দায়ী করব। হে মানুষের সন্তান, ইস্রায়েল জাতির জন্য আমি তোমাকে পাহারাদার নিযুক্ত করেছি” (যিহিষ্কেল ৩৩:১-৯)।
যিহিষ্কেলের আহ্বানের শুরু থেকে ঈশ্বর তাকে ঈশ্বরের বাক্য বলার জন্য দায়ী করেন। কিন্তু লোকেরা কিভাবে সাড়া দেবে, তা যিহিষ্কেলের দায়িত্ব নয়। আমরা আধুনিক যুগে যেমন সফলতার সংজ্ঞা দেই, তা অনুসারে যিহিষ্কেলকে শুরু থেকে বলা হয় যে, তার কোন সফলতা বা জনপ্রিয়তা থাকবে না। কিন্তু ঈশ্বর বিষয়টি ভিন্ন চোখে দেখেন: বাধ্য থাকাই হল সফলতা, এবং যিহিষ্কেল অত্যন্ত বাধ্য।
যিহিষ্কেলের দ্বিতীয় দর্শন যিহিষ্কেল ৮-১১
প্রথম দর্শনের কিছু দিন পরে যিহিষ্কেল দ্বিতীয় বার দর্শন দেখেন। এই দর্শনটি আগের দর্শনের সাথে সম্পর্কিত এবং আগের দর্শনের চেয়েও অদ্ভূত কিছু। তার সামনে বসে আছেন যিহূদীদের প্রাচীনেরা, যারা সম্ভবত যিহিষ্কেলের কাছ থেকে একটি বাণী পাওয়ার জন্যই যিরূশালেম থেকে এসেছেন। হতে পারে, তারা ভাববাদী যিরমিয়ের বাণীগুলো অপছন্দ করেন, তাই তারা যিহিষ্কেলের কাছে এসেছেন।
প্রাচীনেরা যিহিষ্কেলের সামনে বসে থাকা অবস্থায় তিনি দ্বিতীয় দর্শনটি দেখেন। দর্শনে তাকে যিরূশালেম শহরে সদাপ্রভুর উপাসনা-ঘরে নেওয়া হয় এবং তিনি গুপ্তচরের মত দেখেন সেখানে বাস্তবে কি চলছে: প্রথমে তিনি উপাসনা-ঘরের ভিতরের উঠানে “একটি প্রতিমা” দেখেন (কেরী অনুবাদে “অন্তর্জ্বালাজনক অন্তর্জ্বালার প্রতিমা”)। তিনি দেখেন উপাসনা-ঘরের একটি কামরায় ইস্রায়েলের প্রাচীনেরা কিভাবে বুকে হাটা প্রাণীর জঘণ্য আরাধনা করছেন (সম্ভবত যে প্রাচীনেরা বাস্তবে যিহিষ্কেলের সামনে বসে আছেন, তিনি তাদেরকে দর্শনে যিরূশালেমে দেবতাপূজায় ব্যস্ত দেখেন)। তিনি দেখেন, মহিলারা কিভাবে সদাপ্রভুর উঠানে একটি বাবিলীয় দেবের পূজা হিসাবে কান্ন-কাটি করছে এবং শেষে তিনি দেখেন, কিভাবে ২৫জনের মত যিহূদী সদাপ্রভুর ঘরের দিকে পিঠ দেখিয় পূর্ব দিকে উবুড় হয়ে সূর্যকে আরাধনা করছে! ঈশ্বর তাকে জিজ্ঞাসা করেন “হে মানুষের সন্তান, তুমি এটা দেখলে? যিহূদার লোকেরা যে জঘন্য কাজ এখানে করছে তা করা তাদের পক্ষে কি একটা সামান্য ব্যাপার? তারা অত্যাচারে দেশটা ভরে তুলেছে এবং অনবরত আমার অসন্তোষ খুঁচিয়ে তুলছে। দেখ, তারা আমাকে কি ভীষণ অপমান করছে” (যিহিষ্কেল ৮:১৭)। এই প্রশ্নটিতে একটি সত্য প্রকাশিত: যেখানে দেবতাপূজা চলে, সেই সমাজে বিভিন্ন ধরণের অন্যায় ও অত্যাচারও দেখা দেয়। এসব দেখে ঈশ্বর ধ্বংসবাণী ঘোষণা করেন: “কাজেই আমি ক্রোধে জ্বলে উঠে তাদের সংগে ব্যবহার করব; আমি তাদের মমতার চোখে দেখব না বা তাদের রেহাই দেব না” (যিহিষ্কেল ৮:১৮)।
পরে যিহিষ্কেল দর্শনে একজন মসীনা কাপড় পরা একজন লোককে দেখেন, যার কোমরের পাশে লেখার সরঞ্জাম ছিল। তিনি যিরূশালেম শহরে এমন লোকদেরকে, যারা “যে সব জঘন্য কাজ করা হয়েছে সেইজন্য … দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে কোঁকাচ্ছে” তাদের কপালে একটি করে চিহ্ন দেন। পরে তিনি শহর-ধ্বংসের কাজে নিযুক্ত ৬জন লোককে দেখতে পান, যাদেরকে ঈশ্বর আদেশ দেন, উপাসনা-ঘর থেকে শুরু করে যতজনের কপালে চিহ্ন না থাকে, ততজনকে মেরে ফেলতে (যিহিষ্কেল ৯:১-৭)। এইটি দেখে যিহিষ্কেল চিৎকার করে বিনতি শুরু করেন, কিন্তু ঈশ্বর তাকে বলেন যে, বিষয়টি এমন পর্যায় চলে গেছে যে আর দয়া করা ঠিক হবে না (যিহিষ্কেল ৯:৮-১১)।
আরো হতভম্ব করার বিষয়: যিহিষ্কেল আগের মত ঈশ্বরের ভ্রাম্যমান সিংহাসন দেখতে পান, কিন্তু এইবার ঈশ্বরের উপস্থিতি ধাপের পর ধাপ যিরূশালেমের উপাসনা-ঘর থেকে চলে যায়: মন্দিরের মাঝখান থেকে ঈশ্বরের উপস্থিতি মন্দিরের চৌকাঠে সরে আসে (যিহিষ্কেল ৯:৩), পরে মন্দিরের দক্ষিণ পাশে (যিহিষ্কেল ১০:৩), পরে মন্দিরের উঠানের উত্তরের ফটকে সরে আসে (যিহিষ্কেল ১০:১৯)। সেখান থেকে ঈশ্বরের উপস্থিতি উপসনা-ঘর ছেড়ে শহরের মাঝখানে এবং পরে শহরের পূর্বের একটি পাহাড়ে সরে আসে (যিহিষ্কেল ১১:২৩)। এভাবে যিহিষ্কেল নিজেকে আবার বাবিলে খুঁজে পান।
এই অদ্ভূত দর্শন তার প্রধান বাণী হয়ে যায়: ঈশ্বরের উপস্থিতি, দয়া ও আহ্বান আর যিরূশালেমে থাকা যিহূদীদের উপর নয় (এর চেয়ে বলা যায় যে, তারাই যিরূশালেমে ফাঁদে পড়া ইঁদুরের মত), বরং বাবিলে নির্বাসিত যিহূদীদের উপর, যারা ঈশ্বরের বিচারের মধ্য দিয়ে গিয়েছে এবং তাঁর সংশোধন মেনে নিয়েছে। এভাবে যিহিষ্কেল হয়ে যান নির্বাসিত যিহূদীদের উৎসাহ-দাতা। তিনি তাদেরকে নিশ্চয়তা দেন যে, ঈশ্বর তাদেরকে ত্যাগ করেন নি বা ভুলেও যান নি। তিনি তাদেরকে উৎসাহিত করেন, যেন তারা নির্বাসনকে ঈশ্বরের সংশোধন হিসাবে গ্রহণ করে, নির্বাসনে ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বস্ত থাকে এবং আশা ধরে রাখে যে, ঈশ্বর তাঁর প্রতিজ্ঞা অনুসারে অবশ্যই এক দিন তাদেরকে নির্বাসন থেকে প্রতিজ্ঞাত দেশে ফিরে নিয়ে আসবেন। ঈশ্বরের আশীর্বাদ ও আহ্বান যিরূশালেমে থাকা যিহূদীদের উপরে নয়, বরং নির্বাসিত যিহূদীদের উপরে, যাদেরকে ঈশ্বর নির্বাসনে সুরক্ষিত করে রাখবেন এবং যাদেরকে নিয়ে ঈশ্বর পরবর্তীতে একটি নতুন শুরু ঘটাবেন। ভাববাদী যিরমিয় যিরূশালেমে ঠিক একই বাণী দিচ্ছেন (যিরমিয় ২৯:৫-১৪, ৩৮:১৭-১৮)।
যিরূশালেমের ধ্বংস নাটকীয়ভাবে দেখানো যিহিষ্কেল ৪-২৪
যিহিষ্কেল ৫৯২ থেকে ৫৮৭ খ্রীষ্টপূর্ব পর্যন্ত বাবিলে নির্বাসিতদের কাছে ঠিক এই সংবাদগুলো দিতে থাকেন। ঈশ্বর তাকে যিরূশালেমের আসন্ন ধ্বংসবাণী বিভিন্ন নাটকের মাধ্যমে উপস্থাপন করতে বলেন: যিহিষ্কেল যিরূশালেমের ঘেরাওয়ের নাটক দেখান, তিনি প্রায় এক বছর পর্যন্ত বন্দী হওয়ার মত করে এক পাশে শুয়ে সীমিত পরিমানে খাবার ও জল খান, তিনি তার চুল কামিয়ে তা নিয়ে যিহূদীদের উপরে ঈশ্বরের বিভিন্ন ধরণের বিচার উপস্থাপন করেন (যিহিষ্কেল ৪-৫)। তিনি চোখ ঢেকে দিয়ে “দূরে বন্দী হয়ে যাবার মত করে … দেওয়ালে গর্ত খুড়ে জিনিসপত্র তার মধ্য দিয়ে” বের করে নেন এবং এভাবে যিহূদার রাজা সিদিকিয়ের গ্রেফতার ও নির্বাসন নাটকীয়ভাবে উপস্থাপন করেন (যিহিষ্কেল ১২)।
যিহিষ্কেল স্বার্থপর সরকারি নেতাদের এবং দেবতাপূজায় আসক্ত প্রাচীনদের বিরুদ্ধে বাণী দেন এবং সেই সব ভ্রান্ত ভাববাদীদের বিষয়ে সাবধান করেন, যারা লোকদেরকে যা তারা শুনতে চায় তা-ই তাদেরকে শোনায় (যিহিষ্কেল ১৩-১৪)।
যিহিষ্কেল দৃষ্টান্ত ও কাহিনী-ভিত্তিক রূপকও বলেন: তিনি যিরূশালেমকে আঙ্গুর গাছের কাঠের সাথে তুলনা করেন, যা কোনো কাজে লাগানো যায় না (যিহিষ্কেল ১৫)। তিনি ঈগলের একটি গল্প বলেন যাতে তিনি দেখান যে, বাবিলের বিরুদ্ধে যিহূদার রাজা সিদিকিয়ের বিদ্রোহ টিকবে না (যিহিষ্কেল ১৭)। তিনি সিংহী ও তার বাচ্চাদের একটি গল্প বলেন যা দেখায় যে, যিহূদার রাজবংশ রাজত্ব ধরে রাখতে পারবে না (যিহিষ্কেল ১৯)। তিনি ইস্রায়েল জাতির ইতিহাস একটি পরিত্যাগ করা মেয়ের গল্প হিসাবে বলেন, যাতে ঈশ্বর মেয়েটি সম্মান ও ভালবাসার সঙ্গে লালন-পালন করেন কিন্তু মেয়েটি বড় হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যভিচার করে (যিহিষ্কেল ১৬)। তিনি আরো বাজে একটি গল্প বলেন, যাতে দু’জন বোন লজ্জাহীনভাবে অনৈতিক ব্যবহার করে, যা ঈশ্বরের প্রতি ইস্রায়েল ও যিহূদা দেশের খারাপ ব্যবহার বুঝায় (যিহিষ্কেল ২৩)।
নির্বাসিতদের মনে একটি ভুল চিন্তা আছে যে, ঈশ্বর অন্যায় করে তাদের পূর্বপুরুষদের পাপের কারণে তাদেরকে শাস্তি ভোগ করতে দিচ্ছেন। যিহিষ্কেল এই ভুল চিন্তা ভাঙ্গার জন্য বলেন যে, ঈশ্বর কাউকে বিচার করতে আনন্দ পান না এবং তিনি একজন ব্যক্তিকে শুধু নিজেরই খারাপ সিদ্ধান্তের জন্য বিচার করে থাকেন (যিহিষ্কেল ১৮)।
যিহিষ্কেল একটি ভয়ংকর ছবিতে যিরূশালেমের বিরুদ্ধে ঈশ্বরের এমন একটি তলোয়ার দেখেন, যা খাপ থেকে বের করা, ধার দেওয়া, পালিশ করা তলোয়ার (যিহিষ্কেল ২১)। তিনি যিরূশালেমকে “রক্তপাতের এই শহর” বলেন (যিহিষ্কেল ২২:১) এবং যেমন করে “রূপা, পিতল, লোহা, সীসা ও দস্তা জড়ো করে চুলায় দিয়ে গলাবার জন্য আগুনে ফুঁ” দেওয়া হয় ঠিক তেমনি করে ঈশ্বর তাঁর “ভীষণ অসন্তোষ ও ক্রোধে” তাদের “জড়ো করে শহরের মধ্যে রেখে” গলাবেন। যিহিষ্কেল বিশেষভাবে যিহূদার প্রাচীনদের এবং রাজপুত্রদের দোষ ধরেন (যিহিষ্কেল ২২)। তিনি একটি ধ্বংসবাণী বলেন, ঠিক সেই দিনে যখন অনেক দূরে যিরূশালেমে বাবিলীয় সৈন্যদল পৌঁছে শহরের চারিদিকে ঘেরাও বসিয়ে দেয় (যিহিষ্কেল ২৪:১-২, ৯ম বছর, ১০ম মাস, ১০ম দিনে, আধুনিক পঞ্জিকা অনুসারে প্রকাশ করলে তা ১০ জ্যানুয়ারী ৫৮৭ খ্রীষ্টপূর্বে বুঝায়)। এই তারিখের পরে, অর্থাৎ ঘেরাও বসানোর পরে যিরূশালেম থেকে আর কেউ পালাতে সক্ষম হবে না। শহরে ‘ফাঁসি’ লাগানোই আছে। যখন যিহিষ্কেলের “নয়নের প্রীতিপাত্রকে” (কেরী), অর্থাৎ তার স্ত্রী মারা যান, তখন ঈশ্বর যিহিষ্কেলকে প্রকাশ্যে শোক করার অনুমতি দেন না। এটা রূপক অর্থে বুঝায় যে, ঈশ্বর যিরূশালেমের প্রতি সব মায়া-দয়া ত্যাগ করেছেন এবং শহরের ধ্বংসের দিন কাছে এসে গেছে (যিহিষ্কেল ২৪:১৫-২৭)।
এইসব বাণী দিতে দিতে ঈশ্বর যিহিষ্কেলের কথা বলার ক্ষমতা বেশ কয়েকটি বছর ধরে সীমিত করে রাখেন: নির্বাসিত যিহূদীদের বাণী দেওয়ার সময় ছাড়া যিহিষ্কেল আর কোনো কথা বলতে পারেন না (যিহিষ্কেল ৩:২২-২৭)। অন্য সময় কথা বলতে পারেন না বলে, যখন যিহিষ্কেল মুখ খুলে বাণী দেন তখন তার এই কথায় আরো গুরুত্ব থাকে। তার নিরব থাকা বা কথাহীন অবস্থা-ই হয়ে যায় শক্তিশালী একটি সংবাদ এবং সেই অল্প কথা যা তিনি বলতে পারেন, সেগুলো আরো ভার পায়। ৫৮৭ খ্রীষ্টপূর্বে যখন যিরূশালেমে বাবিলীয়েরা তৃতীয় বার ঘেরাও বসায়, তখন থেকে যিহিষ্কেল সম্পূর্ণ বোবা হয়ে যান। যা বলার আছে তা বলা হয়েছে, ধ্বংসের প্রহর গোনা শুরু হয়েছে (যিহিষ্কেল ২৪:২৫-২৭)। শুধুমাত্র যখন যিরূশালেম থেকে একজন পলাতক লোক যিরূশালেমের ধ্বংসের খবর নিয়ে আসে, তখনই যিহিষ্কেল আবার কথা বলতে পারেন (যিহিষ্কেল ৩৩:২১-২২)। তার সব ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ হয়েছে, তিনি একজন সত্যিকারের ভাববাদী হিসাবে প্রমাণিত হয়েছেন (দ্বিতীয় বিবরণ ১৮:২০-২২)।
অন্যান্য জাতিদের সম্বন্ধে বিচারবাণী যিহিষ্কেল ২৫-৩২
পুস্তকের মাঝখানে যিহিষ্কেল বিভিন্ন জাতিদের বিরুদ্ধে বিচারবাণী সংগ্রহ করে লিখে রাখেন। ঈশ্বর যেমন মন্দ যিরূশালেমকে বিচার করবেন, ঠিক তেমনি তিনি অন্য জাতিদেরকেও তাদের মন্দ কাজের জন্য বিচার করবেন। যিহূদা যখন দুর্বল ছিল, ঠিক সেই সময় অন্য জাতিরা যিহূদার বিরুদ্ধে কি মনোভাব ও আচরণ দেখিয়েছে, সেই অনুসারে ঈশ্বর তাদেরকে বিচার করবেন।
ঈশ্বর তাঁর ক্ষমতা ও ন্যায্যতা অন্য জাতিদের কাছেও প্রকাশিত করবেন, যেন তারাও “জানবে যে, আমিই সদাপ্রভু” (যিহিষ্কেল ২৫:১১)। ঈশ্বর তাঁর জাতি যিহূদাকে আইন-কানুনে দায়বদ্ধ করে বিচার করেন, কারণ তাদের কাছে আইন-কানুন ছিল। অন্য জাতিদেরকে ঈশ্বর ‘সোনার নিয়ম’ অনুসারে বিচার করবেন: একটি দেশ তার বিরুদ্ধে একটি আচরণকে যদি অন্যায় হিসাবে ধরে, তবে সেই একই আচরণ যদি আর একটি দেশের বিরুদ্ধে করে তবে দেশটি দোষী হিসাবে প্রমাণিত হয়।
জাতি | বাইবেল পদ | বিচারের কারণগুলো | ফলাফল |
অম্মোন | যিহিষ্কেল ২৫:১–৭ | ইস্রায়েল দেশ ও উপাসনা–ঘরের ধ্বংসে তারা হাততালি দিয়েছে, নেচেছে এবং অন্তরের সঙ্গে হিংসা করে আনন্দ করেছে। | অন্যান্য জাতি ও দেশের মধ্য থেকে ছেঁটে ফেলে ধ্বংস |
মোয়াব | যিহিষ্কেল ২৫:৮–১১ | তারা বলেছে “যিহূদার লোকেরা অন্যান্য সব জাতিদের মত হয়ে গেছে।” | |
ইদোম | যিহিষ্কেল ২৫:১২–১৪ | তারা যিহূদার লোকদের উপর বারবার প্রতিশোধ নিয়ে খুব অন্যায় করেছে। | |
পলেষ্টীয়া | যিহিষ্কেল ২৫:১৫–১৭ | তারা হিংসার মনোভাব নিয়ে যিহূদার উপর প্রতিশোধ নিয়েছে; তারা পুরানো শত্রুতার মনোভাব নিয়ে যিহূদাকে ধ্বংস করতে চেয়েছে। | অন্যান্য জাতি ও দেশের মধ্য থেকে ছেঁটে ফেলে ধ্বংস |
সোর | যিহিষ্কেল ২৬:১–২৮:১৯ | সোর অহংকারে বলেছে যে, সে–ই দেবতা। | |
সিদোন | যিহিষ্কেল ২৮:২০–২৪ | মড়ক, রাস্তায়–রাস্তায় রক্তপাত | |
মিসর | যিহিষ্কেল ২০–৩২ | মিসর অহংকারে দাবি করেছে যে, তারা নীল নদী নিজের জন্য তৈরি করেছে (২৯:৩,৯–১০)। মিসর ইস্রায়েলের জন্য নলের লাঠি হয়েছিল (২৯:৬–৭), অর্থাৎ তারা ইস্রায়েলের সাথে চুক্তি ভেঙ্গেছিল। | ধ্বংস করা হবে এবং বাবিলকে দেওয়া হবে। ৪০ বছর পরে পুনরুদ্ধার ঘটবে (২৯:১৩–১৪)। |
যিহিষ্কেল ২৮:১১-১৯ পদগুলো বিশেষ মনোযোগ পেয়েছে। অনেকে এই পদগুলো শয়তান ও শয়তানের মনোভাবের একটি বর্ণনা হিসাবে ব্যাখ্যা করে থাকে। প্রকৃতপক্ষে পদগুলো নৌক্ষমতা সম্পন্ন ফৈনীকীয়ার রাজধানি সোর সম্বন্ধীয় ভাববাণী। যিহিষ্কেল ঘোষণা করেন যে, সোর শহর ধ্বংস হয়ে যাবে (যিহিষ্কেল ২৬:১-২১)। তিনি সোরকে ‘ডুবে যাওয়ার জাহাজ’ বলেন (যিহিষ্কেল ২৭:১-৩৬), সোরের রাজার পতনের একটি বর্ণনা দেন (যিহিষ্কেল ২৮:১-১০), সোর রাজার মৃত্যু নিয়ে একটি বিলাপ প্রকাশ করেন (যিহিষ্কেল ২৮:১১-১৯), সঙ্গী সিদোন শহর সম্বন্ধীয় একটি ভাববাণী দেন (যিহিষ্কেল ২৮:২০-২৪) এবং ইস্রায়েলকে পুনরায় সুঅবস্থায় আনা দিয়ে কথাটি সমাপ্ত করেন (যিহিষ্কেল ২৮:২৫-২৬)।
পদগুলোর পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে বুঝা যায় যে, যিহিষ্কেল সোরের ধ্বংসের বাণীর মাঝখানে হঠাৎ করে বলবেন না যে, ‘ও, আমি তাড়াতাড়ি মাঝখানে শয়তান সমন্ধে কিছু শিক্ষা দেই’। তাই পদগুলো সরাসরি শয়তান সম্বন্ধীয় নয়। কিন্তু অপর পক্ষে আবারও বলা যায় যে, প্রকৃতপক্ষে সোরের রাজা ছিল অহংকারী, আত্ম-নির্ভরশীল, স্বেচ্ছাচারী, ভক্তিহীন এবং একনায়ক-তন্ত্রের প্রধান, তাই তার এই বর্ণনা অবশ্যই শয়তানের চরিত্র বা আচরনের সাথে বেশ মিল থাকবেই। প্রকৃতপক্ষে, অহংকারী ও স্বেচ্ছাচারী নেতাদের চরিত্র হুবহু দেখায়। ঠিক একই কথা যিশাইয় পুস্তকে বাবিল রাজার বর্ণনা নিয়েও বলা হয়েছে (যিশাইয় ১৪), যা অনেকে শয়তান সম্বন্ধীয় মনে করে।
উদ্ধারের ভবিষ্যদ্বাণীগুলো যিহিষ্কেল ৩৩-৪৮
এসব বিচারবাণীর পরে ঈশ্বর যিহিষ্কেলকে পুনরায় ভাববাদী হিসাবে আহ্বান করেন, কিন্তু এইবার তিনি তাকে আশা-দাতা হিসাবে আহ্বান করেন (যিহিষ্কেল ৩৩:১-২০)। ঈশ্বর যিহিষ্কেলকে অদ্ভূত উদ্ধারের প্রতিজ্ঞাগুলো দেখান, অবিশ্বাস্য ও চমৎকার একটি পুনরুদ্ধার, যা কেউ পাওয়ার যোগ্য নয়।
যেমন ভাববাদী যিরমিয় তার আগে বলেছিলেন, ঠিক তেমনি যিহিষ্কেলও বলেন যে, ঈশ্বর যিহূদীদের নির্বাসন থেকে প্রতিজ্ঞাত দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসবেন এবং তাদেরকে সেখানে সুঅবস্থায় পুনরায় স্থাপন করবেন। প্রতিজ্ঞাটি পূর্ণ হয়ে যায় যখন যিহূদীরা সরুব্বাবিল (৫৩৬ খ্রীঃপূ), ইষ্রা (৪৫৮ খ্রীঃপূঃ) ও নহিমিয়ের নেতৃত্বে (৪৪৪ খ্রীঃপূঃ) বাবিল ছেড়ে যিহূদায় ফিরে আসে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যিহিষ্কেলের বাণীগুলো এই ঐতিহাসিক পূর্ণতার চেয়ে অনেক মহান ও চমৎকার। তিনি বলেন যে, ঈশ্বর ইস্রায়েলকে তাঁর পছন্দ মত একজন মেষপালক দেবেন, যা একটি যীশু সম্বন্ধীয় ভবিষ্যদ্বাণী।
যিহিষ্কেল একটি চমৎকার পুনরুদ্ধারের প্রতিজ্ঞা দেন: সারাংশে বলা যায় যে, বিনতি (যিহিষ্কেল ৩৩), ঈশ্বরীয় নেতৃত্ব (যিহিষ্কেল ৩৪) এবং ঈশ্বরের সুরক্ষা (যিহিষ্কেল ৩৫-৩৬) পুনরায় স্থাপিত হবে। যা মৃত ছিল তা পুনরায় জীবিত করে তোলা হবে (যিহিষ্কেল ৩৭); মন্দ, হিংস্র ও আক্রমণাত্মক মানুষদের পরাজিত করা হবে (যিহিষ্কেল ৩৮-৩৯); একটি খাঁটি উপাসনা-ঘর নির্মাণ করা হবে (যিহিষ্কেল ৪০-৪৩); একটি আইন-শৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণ সমাজ স্থাপন করা হবে (যিহিষ্কেল ৪৪-৪৮) এবং ঈশ্বরের উপস্থিতি থেকে একটি নদী বের হবে, যা জীবন, যোগান ও সুস্থতা নিয়ে আসবে (যিহিষ্কেল ৪৭)। ঈশ্বরের জাতির মধ্যে তাঁর উপস্থিতি পুনরায় স্থাপিত হবে।
ভ্রান্ত মেষপালক, যত্নহীন ভেড়া ও ঈশ্বরের মেষপালক যিহিষ্কেল ৩৪
যিহিষ্কেল তার পুস্তকের প্রথম বিভাগে ভ্রান্ত ভাববাদী (যিহিষ্কেল ১৩), এমন মহিলা যারা দেবতাপূজা শেখায় (যিহিষ্কেল ১৪), দেবতাপূজায় আসক্ত প্রাচীন এবং মন্দ কাজে লিপ্ত রাজপুত্রদেরকে (যিহিষ্কেল ২২) সাবধান করেছিলেন। দ্বিতীয় বিভাগে তিনি খারাপ নেতাদেরকে স্বার্থপর মেষপালকদের সাথে তুলনা করেন (যিহিষ্কেল ৩৪): “ধিক্, ইস্রায়েলের সেই পালকদের, যারা কেবল নিজেদেরই দেখাশোনা করে! … তোমরা তো চর্বি খাও, পশম দিয়ে কাপড় বানিয়ে পর এবং বাছাই করা ভেড়া জবাই কর, কিন্তু তোমরা মেষগুলোর যত্ন কর না। তোমরা দুর্বলদের সবল কর নি, অসুস্থদের সুস্থ কর নি, আহতদের ঘা বেঁধে দাও নি। যারা বিপথে গেছে তাদের তোমরা ফিরিয়ে আন নি কিম্বা হারিয়ে যাওয়া লোকদের খোঁজ কর নি” (যিহিষ্কেল ৩৪:১-৬)। দায়ূদের সময় থেকে এবং তারই কারণে বাইবেলে “রাখাল” বা “পালক” শব্দটি রাজা বা নেতৃত্বের একটি রূপক হিসাবে দাঁড়ায়। ঈশ্বর ঘোষণা করেন: “আমি প্রভু সদাপ্রভু বলছি যে, আমি পালকদের বিপক্ষে; আমি তাদের হাত থেকে আমার মেষগুলোকে আদায় করে নেব” (যিহিষ্কেল ৩৪:১০)। তাদের বিপরীতে ঈশ্বর নিজেই হলেন ভাল মেষপালকের মত: “আমি নিজেই আমার মেষগুলোর খোঁজ নেব ও তাদের দেখাশোনা করব। … আমি আমার মেষগুলোর খোঁজ করব। মেঘ ও অন্ধকারের দিনে তারা যে সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে আমি সেখান থেকে তাদের উদ্ধার করব” (যিহিষ্কেল ৩৪:১১-১৬)। যীশু এই একই রূপক ব্যবহার করে নিজের বর্ণনা হিসাবে বলেন “আমিই সেই উত্তম মেষপালক” (যোহন ১০:১১,১-১৮) এবং ঈশ্বর যীশুকে বুঝিয়ে যিহিষ্কেল দ্বারা এই প্রতিজ্ঞা দেন: “আমি তাদের উপরে একজন পালককে, অর্থাৎ আমার দাস দায়ূদকে নিযুক্ত করব; সে নিজেই তাদের দেখাশোনা করবে এবং তাদের পালক হবে। আমি সদাপ্রভু তাদের ঈশ্বর হব এবং আমার দাস দায়ূদ তাদের নেতা হবে। আমি সদাপ্রভু এই কথা বলছি” (যিহিষ্কেল ৩৪:২৩-৩১)। কিন্তু ঈশ্বর যে শুধুমাত্র খারাপ নেতাদের দায়বদ্ধ করে রাখেন তা নয়, বরং তিনি স্বার্থপর ভেড়াদেরও দায়বদ্ধতায় নিয়ে আসেন (যিহিষ্কেল ৩৪:১৭-১৯)। তিনি আগেও ঘোষণা করেছিলেন: প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজের আচরনের জন্য দায়ী। তাই নেতারা দায়ী, কিন্তু অনুসরণকারীরাও দায়ী।
যিহিষ্কেলের তৃতীয় দর্শন: শুকনা হাড়ের উপত্যকা যিহিষ্কেল ৩৭
যিহিষ্কেল পুস্তকের সবচেয়ে বিখ্যাত দর্শন হল ‘শুকনা হাড়ের উপত্যকা’। ঈশ্বরের আদেশে তিনি শুকনা হাড়ের উপরে ঘোষণা করেন যে, ঈশ্বর হাড়ের মধ্যে নিঃশ্বাস ঢুকিয়ে সেগুলো জীবিত করে তুলবেন। দর্শনে তা-ই হয়, হাড়গুলো জীবিত হয়ে উঠে এবং একটি বিরাট সৈন্যদলে পরিণত হয়।
দর্শনের অর্থ ঈশ্বরের বাণীতে পরিষ্কারভাবে প্রকাশিত: “আমি তোমাদের কবর খুলে সেখান থেকে তোমাদের তুলে আনব। ইস্রায়েল দেশে আমি তোমাদের ফিরিয়ে আনব। আমি যখন তোমাদের কবর খুলে সেখান থেকে তোমাদের বের করে আনব তখন তোমরা জানবে যে, আমিই সদাপ্রভু। আমার আত্মা আমি তোমাদের মধ্যে দেব এবং তোমরা জীবিত হবে। তোমাদের নিজেদের দেশে আমি তোমাদের বাস করাব। তখন তোমরা জানবে যে, আমি সদাপ্রভুই এই কথা বলেছি এবং তা করেছি” (যিহিষ্কেল ৩৭:১২-১৪)।
দর্শনটি হল ঈশ্বরের উদ্ধারের একটি অদ্ভূত ও অতি শক্তিশালী ছবি: মৃত্যু থেকে জীবন, নির্বাসন থেকে নিজের দেশে ফিরে যাওয়া, ঈশ্বরবিহীন অবস্থা থেকে অন্তরে ঈশ্বরের আত্মার উপস্থিতি। বাবিলে নির্বাসিত যিহূদীদের জন্য তা ছিল একটি প্রতিজ্ঞা, যা নিশ্চয়তা দেয় যে, যিহূদীরা এখনও ঈশ্বরের লোক, তাঁর আহ্বান এখনও তাদের উপরে আছে এবং ঈশ্বরের ভবিষ্যদ্বাণীগুলো অবশ্যই পূর্ণ হবে।
প্রাথমিকভাবে এই ভবিষ্যদ্বাণীর পূর্ণতা হল ৫৩৬ খ্রীষ্টপূর্বে, যখন মাদিয়-পারস্যেরা বাবিল সাম্রাজ্যকে পরাজিত করে নির্বাসিত যিহূদীদের নিজেদের দেশে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যারা ফিরেছে, তারা ছিল ছোট দল এবং পরবর্তীতে প্রতিজ্ঞাত দেশে তাদের অবস্থা তেমন বেশি ভাল ছিল না। যিহিষ্কেলের ভবিষ্যদ্বাণী আরো অনেক বড় কিছু প্রতিজ্ঞা করে: “তাদের সব প্রতিমা, মূর্তি কিম্বা তাদের কোন অন্যায় দিয়ে তারা আর নিজেদের অশুচি করবে না। তাদের সব পাপ ও বিপথে যাওয়া থেকে আমি তাদের রক্ষা করব এবং শুচি করব। তারা আমার লোক হবে এবং আমি তাদের ঈশ্বর হব। … আমি তাদের জন্য একটা মংগলের ব্যবস্থা স্থাপন করব; সেটা হবে একটা চিরস্থায়ী ব্যবস্থ” (যিহিষ্কেল ৩৭:২৩,২৬)। বাণীটি যিহূদীদের জন্য আরো বড় একটি আশা দেয় এবং তাদেরকে মশীহের আগমনের জন্য প্রস্তুত করে, যিনি এই চমৎকার ভবিষ্যদ্বাণীর প্রকৃত পূর্ণতা।
ঈশ্বর মাগোগের গোগকে পরাজিত করবেন যিহিষ্কেল ৩৮-৩৯
যিহিষ্কেল বলেন যে, ভবিষ্যতে ঈশ্বরের লোক যখন শান্তিতে এবং দেওয়াল-দুর্গ ছাড়া বাস করবে (একটি ছবি যা সম্ভবত বিশ্বাসীদেরকে বুঝায়, যারা সুরক্ষার ব্যবস্থা ছাড়া অবিশ্বাসীদের মধ্যে বাস করবে), তখন মাগোগ দেশের শাসনকর্তা গোগ তাদেরকে আক্রমণ করবে। মাগোগের গোগ সম্ভবত ঈশ্বরের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো দমনকারী ও হিংস্র রাজ্যের একটি ছবি। ভয়ংকর আক্রমণ হলেও সব কিছু ঈশ্বরের নিয়ন্ত্রণে আছে, তিনি গোগের চূড়ান্ত পরাজয় এবং তাঁর লোকদের চিরকালীন উদ্ধার নিশ্চিত করবেন। এই যুদ্ধে ঈশ্বরের লোকদেরকে কিছুই করতে হবে না বরং ঈশ্বর নিজেই সব কিছু করবেন। মানুষ হিসাবে আমাদেরকে শুধুমাত্র নিশ্চিত করতে হয় যে, আমরা যুদ্ধের সঠিক পাশে আছি কিনা।
যিহিষ্কেলের চতুর্থ দর্শন: পুনরুদ্ধার যিহিষ্কেল ৪০-৪৮
যিহিষ্কেল এই শেষ দর্শনটি ৫৭২ খ্রীষ্টপূর্ব উদ্ধার পর্বের সময়ে দেখেন (যিহিষ্কেল ৪০:১)। উদ্ধার পর্বে যিহূদীরা মিসরের বন্ধন থেকে ঈশ্বরের উদ্ধার এবং পরবর্তীতে ঈশ্বরের সাথে তাদের দেখা স্মরণ করে, যা এই দর্শনের সাথে মিলে। যিহিষ্কেলের বয়স যখন ৫০ বছর, অর্থাৎ সেই বয়স যখন পুরোহিতেরা পরিচর্যা ছেড়ে অবসরে যেত, তখন ঈশ্বর তাকে উপাসনা-ঘর, শহর, জাতি ও দেশের একটি চমৎকার চূড়ান্ত দর্শন দেখান।
যিহিষ্কেলের আগের দর্শনে ঈশ্বর তাকে দেখিয়েছিলেন কিভাবে তাঁর উপস্থিতি যিরূশালেমের উপাসনা-ঘর ত্যাগ করে চলে যায় (যিহিষ্কেল ৮-১১)। তাকে যিরূশালেম সম্বন্ধে যথেষ্ট ধ্বংসবাণী দিতে হয়েছিল (যিহিষ্কেল ২৪) যা ৫৮৬ খ্রীষ্টপূর্বে পূর্ণ হয়। কিন্তু এখন ঈশ্বর তাকে একটি চমৎকার উপাসনা-ঘর পুনর্স্থাপনের দর্শন দেখান (যিহিষ্কেল ৪০-৪৩)।
যিহিষ্কেলের শেষ দর্শন অনেক বড় ও বিস্তারিত: তিনি নতুন একটি উপাসনা-ঘর ও বেদী বর্ণনা করেন (যিহিষ্কেল ৪০-৪৩), বেদীর উৎসর্গ করার অনুষ্ঠান, উপাসনা-ঘরের শুচিতা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা (যিহিষ্কেল ৪৪), পবিত্র এলাকার অবস্থান, সামাজিক আইন-কানুন, উৎসর্গ ও পর্বগুলো (যিহিষ্কেল ৪৫), বিশ্রামবার পালনের নিয়ম এবং সেই সময় রাজপুত্রের বিশেষ দায়িত্বসমূহ (যিহিষ্কেল ৪৬) – এসবের বর্ণনা দেন।
পরবর্তীতে যিহিষ্কেল বর্ণনা করেন, কিভাবে উপাসনা-ঘরের চৌকাঠের নিচ থেকে একটি নদী বের হয়ে আসে এবং পূর্ব দিকে যত বয়ে যেতে থাকে, তত গভীর হতে থাকে। নদীর পাড়ে আছে চির-সবুজ গাছ, যাদের ফল খাবার এবং যাদের পাতা সুস্থ হওয়ার ব্যবস্থা যোগান দেয় (যিহিষ্কেল ৪৭)। তিনি আরো বর্ণনা করেন, কিভাবে প্রতিজ্ঞাত দেশের ভূমি পুনরায় বংশদের মধ্যে ভাগ করা হয়, যদিও ভাগ করার পদ্ধতিটি মোশি ও যিহোশূয়ের পদ্ধতি থেকে খুবই ভিন্ন। যিহিষ্কেল তার পুস্তক এই বলে সমাপ্ত করেন: “সেই সময় থেকে শহরের নাম হবে, “সদাপ্রভু এখানে আছেন’ ” (যিহিষ্কেল ৪৮:৩৫)।
যিহিষ্কেলের এই শেষ দর্শন আমরা কিভাবে বুঝব?
- লক্ষণীয় বিষয় হল যে, যদিও নির্বাসন থেকে ফিরে আসা যিহূদীদের হাতে যিহিষ্কেলের পুস্তক, অর্থাৎ উপাসনা-ঘরের এই বর্ণনা ছিল, তবুও তারা যে এই নির্দেশনাগুলো অনুসারেই উপাসনা-ঘর নির্মাণ করতে চেষ্টা করেছিল, তার কোনো উল্লেখ নেই।
- প্রকৃতপক্ষে, যদি এই অধ্যায়গুলো (যিহিষ্কেল ৪০-৪৮) আক্ষরিক অর্থে ব্যাখ্যা করা হয় তবে অনেক প্রশ্ন উঠে আসতে পারে।
- দর্শনে অনেক খুঁটিনাটি বিষয় বর্ণনা করা হয়েছে, কিন্তু আবারও বেশ কিছু তথ্য বা মাপ দেওয়া হয় নি (যেমন উপাসনা ঘরের উচ্চতা)।
- কয়েকটি বিষয় আগের উপাসনা-ঘর থেকে এই নতুন উপাসনা-ঘরে বেশ ভিন্ন এবং তার কোন কারণ বা ব্যাখ্যা দেওয়া হয় নি।
- সম্পূর্ণ নতুন হল: রাজপুত্রের ভূমিকার উপরে গুরুত্ব দান এবং জমির সম্পূর্ণ নতুন ধরণের ভাগ।
- ইতিহাসে যিহিষ্কেলের বর্ণনা অনুসারে কোনো উপাসনা-ঘর তৈরি হয় নি বলে কেউ কেউ ব্যাখ্যা করে যে, যীশুর দ্বিতীয় আগমনে এক হাজার বছর রাজত্ব করার সময়ে যীশুই যিহিষ্কেল পুস্তকে বর্ণিত উপাসনা-ঘর হুবহু নির্মাণ করবেন।
- কিন্তু এই ব্যাখ্যা নিয়েও অনেক প্রশ্ন উঠে আসতে পারে। যীশুর ক্রুশীয় মৃত্যুর পরে আবার বেদীতে পশুর উৎসর্গ চালিয়ে নেওয়ার অর্থই বা কি?
- এর চেয়ে ভাল যদি আমরা দর্শনটি রূপকভাবে বুঝি, কারণ নতুন নিয়মে সদাপ্রভুর উপাসনা-ঘর বা মন্দির রূপক অর্থেও ব্যাখ্যা করা হয়।
- সেই অতি চমৎকার দালানের কাঠামো হয়তো ঈশ্বরের উদ্ধারের সম্পূর্ণতা ও খাঁটি ভাব দেখায়, যা দ্বারা যীশুকে বুঝানো হয়, যিনি নিজেই ‘উপাসনা-ঘর’ বা ‘ঈশ্বরের মন্দির’। তিনি হলেন ‘ঈশ্বর আমাদের সঙ্গে সঙ্গে বাস করেন’, অর্থাৎ তিনিই ‘ইম্মানুয়েল’। এবং যীশু তার অনুসরণকারীদের (যিহূদী এবং অযিহূদী উভয়) একটি জীবিত মন্দিরে পরিণত করেন, যার মধ্যে পবিত্র আত্মা বাস করেন, প্রত্যেকটি বিশ্বাসীর হৃদয়ে এবং একই সাথে মণ্ডলীতেও।
- মন্দির থেকে যে নদী বের হয়, তা হল খ্রীষ্টের মধ্য থেকে সেই উপচে পড়া স্রোতের একটি ছবি (যোহন ৮:৩৭), তাঁকে দ্বারা স্থাপিত মণ্ডলীও সেই উপচে পড়া স্রোতের একটি অংশ হয়ে যায়, যা যেখানে যায় না কেন সেখানে জীবন নিয়ে আসে। নদী হল ঈশ্বরের অনন্ত জীবনের একটি ছবি, সুসমাচারের সত্যেরও ছবি, যা এগিয়ে যায় এবং যেখানে পৌঁছায় সেখানে ঈশ্বরে রাজ্য বিস্তার করে, এমন সময় পর্যন্ত যখন ঈশ্বরের জ্ঞানে পৃথিবী পূর্ণ হয়ে যায় (একই চিন্তা পাওয়া যায় প্রকাশিত বাক্য ২২:১-২, যোয়েল ৩:১৮, সখরিয় ১৪:৮, হবক্কূক ২:১৪, যিশাইয় ১১:৯ পদে)।
- নদীর পাড়ের সেই গাছগুলো হল সৃষ্টিকে সম্পূর্ণভাবে পুনরায় স্থাপনের একটি ছবি, যেখানে পাপের খারাপ ফলাফল মুছে ফেলা হয়, যেখানে নতুন একটি মহাকাশ ও নতুন একটি পৃথিবী সৃষ্টি করা হয়। যিহিষ্কেল পুস্তকটি সমাপ্ত হয় যেমন প্রকাশিত বাক্যও সমাপ্ত হয়: ঈশ্বর তাঁর লোকদের সঙ্গে সঙ্গে আছেন, অর্থাৎ “সদাপ্রভু এখানে আছেন”।
যিহিষ্কেল তার সমসাময়িক নির্বাসিত যিহূদীদের চোখ ভবিষ্যতের দিকে আকৃষ্ট করেন, যখন ঈশ্বর অদ্ভূত একটি পুনরুদ্ধার ঘটাবেন। তাতে যেন তারা আশা ও অনুপ্রেরণা পেয়ে বিশ্বস্ত হয় এবং ঈশ্বরের উপর নির্ভর করে, যিনি তাঁর প্রতিজ্ঞা নিশ্চিত পূর্ণ করবেন, এমন কি তাদেরই মধ্য দিয়েই তা করবেন।
বিস্তারিত অধ্যনের জন্য www.englishbiblestudy.com দেখুন।