পরিবার ০৩ – বিবাহবিচ্ছেদ এবং পুনরায় বিবাহ

নিচের শিক্ষাটি ডেভিড ইনস্টন-ব্রূয়ারের ‘Divorce & Remarriage in the Bible (বিবাহবিচ্ছেদ ও পুনর্বিবাহ’ বিষয়ে – বাইবেল )’ এই চমৎকার বইয়ের একটি সারাংশ

অধিকাংশ শিক্ষা উল্লিখিত বই থেকে নেওয়া হয়েছে। তবে যেখানে নতুন বা অন্য চিন্তা যোগ করা হয়েছে, তা ছাই রং দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে।

সব কিছুর ভিত্তি: বিবাহ ও পরিবারের অনুমোদন

  • আইন-কানুনের মধ্য দিয়ে ঈশ্বর ‘বিবাহ, পরিবার, সন্তান ও চুক্তি’ রক্ষা করতে চান। অর্থাৎ পরিবারের প্রত্যেকের, বিশেষভাবে স্ত্রী ও সন্তানদের সুরক্ষার জন্য আইন দেওয়া হয়েছে।
যাত্রা ২০:১৪, দ্বিতীয় বিবরণ ৫:১৮ “ব্যভিচার করো না।”
  • এই আইনের মধ্য দিয়ে ঈশ্বর ‘বিবাহ, পরিবার, সন্তান ও চুক্তি’ রক্ষা করতে চান। অর্থাৎ পরিবারের প্রত্যেকের, বিশেষভাবে স্ত্রী ও সন্তানদের সুরক্ষার জন্য আইন দেওয়া হয়েছে।
  • ঈশ্বর এমন বিবাহ চান, যেখানে স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের নিরাপদ ব্যবস্থা রয়েছে, যেখানে দু’জনই পরস্পরের প্রতি বিশ্বস্ত, উভয়েই একে অপরের প্রতি ন্যায্য ব্যবহারে সমর্পিত এবং সেখানে দু’জনই ফুটে ওঠে।
  • হিতোপদেশে বিশেষভাবে স্বামীদের জন্য একটি আদেশ রয়েছে: নিজের স্ত্রী নিয়ে সন্তুষ্ট হও! “তোমার নিজের জমা করা জল থেকেই তুমি জল খাও; তোমার নিজের কূয়ার টাটকা জল খাও।…১৭ তোমার সন্তানেরা তোমার একারই থাকুক, ব্যভিচারিণীদের তাতে ভাগ না থাকুক, ১৮ তোমার ফোয়ারায় আশীর্বাদ থাকুক, তোমার যৌবনের স্ত্রীকে নিয়েই তুমি আনন্দ কর” (হিতো ৫:১৫-১)।
  • প্রলোভনে পড়ার বিষয়ে সাবধান: “যদি কেউ আগুন তুলে নিয়ে নিজের কোলে রাখে তবে কি তার কাপড় পুড়ে যাবে না? যদি কেউ জ্বলন্ত কয়লার উপরে হাঁটে তবে তার পা কি পুড়ে যাবে না?” (হিতো ৬:২৭-২৮)। যৌন আকর্ষণের ক্ষেত্রে ‘আগুন’ নিয়ে খেলবেন না! ঝুঁকি নেবেন না!
  • যে চুক্তি ও শপথ করেছেন, তা ভাঙ্গবেন না। অন্যের বিশ্বাস নষ্ট করবেন না। বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না।
  • তা করলে আপনি আপনার বৈবাহিক সম্পর্ককে ইচ্ছাকৃতভাবে চরম ঝুঁকিতে রাখেন। ব্যভিচার করলে বৈবাহিক সম্পর্ককে সংকটে ফেলা হয় এবং কখনও কখনও বিবাহ সম্পূর্ণভাবে ভেঙ্গেও যায়।

পুরাতন নিয়মের ঐতিহাসিক পটভূমি

প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্যের ‘বিবাহের চুক্তি’
  • প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্য দেশে বিভিন্ন ধরণের চুক্তি প্রচলিত ছিল: যেমন দু’টি গোষ্ঠি বা দেশের মধ্যে চুক্তি, অর্থনৈতিক চুক্তি বা দেবতার সঙ্গে চুক্তি। ঠিক তেমনি বিবাহও দু’টি পরিবারের মধ্যে চুক্তি হিসাবে দেখা হত।
  • মোশির আইন-কানুনে বিবাহের বিষয়ে বিস্তারিত নিয়ম বা সব ধরণের পরিস্থিতি সম্বন্ধীয় নির্দেশনা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, এমন নয়। সম্ভবত, যখন ঈশ্বরের আদেশ চারিদিকের দেশগুলোর আইন থেকে ভিন্ন, শুধুমাত্র তখনই সেই আইন মোশির আইন-কানুনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, যেমন দ্বিতীয় ২৪:১-৪
  • চুক্তিগুলো একটি দলিল বা একটি অনুষ্ঠান দ্বারা স্থাপিত হত।
  • চুক্তি রক্ষার্থে উভয় দল নিজেকে কিছু নিয়মে সমর্পিত করত, কোন একটি দল যদি চুক্তির নিয়ম ভাঙ্গে, সেক্ষেত্রে ফলাফলস্বরূপ কি শাস্তি থাকবে, তা-ও চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল।
  • বৈবাহিক চুক্তির গুরুত্ব নিশ্চিত করা এবং দু’দলের নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য চুক্তি স্থাপন করার সময় টাকা দিতে হত (payments) এবং চুক্তি ভাঙ্গলে শাস্তিস্বরূপ জরিমানা হিসাবে টাকা দিতে হত (penalties)। যেমন:
    • (১) দেনমোহর বা বরপণ (Bride-price): এই টাকা (অনেক বার ১০ মাসের বেতনস্বরূপ) বর কনের পিতাকে দিয়ে থাকে। তা দিয়ে নিশ্চিত করা হত যেন লোকদের বিবাহ সম্বন্ধে অতি হালকা মনোভাব না থাকে।
    • মাঝে মাঝে কোন বরপক্ষ কনেকে বা কনের পরিবারকে উপহার দিয়ে থাকে (আদি ২৪:২২)।
    • (২) যৌতুক (ইব্রীয় ‘nedunya’), সাধারণভাবে এটি কনের পিতা কনেকে দিয়ে থাকে। এটি হল কনের পৈতৃক উত্তরাধিকার, অর্থাৎ পিতৃ পরিবার থেকে কনের পাওনা অংশ, তবে বিবাহের পরে সাধারণত কনের স্বামী তা দেখাশোনা করে থাকে।
  • যৌতুক ছিল কনের সম্পত্তি এবং কনের জন্য এক ধরণের নিরাপত্তার ব্যবস্থা: বিয়ের পর স্বামী মারা গেলে অথবা বিবাহবিচ্ছেদ হলে, তবে এই যৌতুকের অংশ দিয়ে স্ত্রী তার পরবর্তী জীবন পরিচালনা করতে সাহায্য পেত। কিছু ক্ষেত্রে স্বামী মারা গেলে স্ত্রী তার পৈতৃক উত্তরাধিকার ফিরে পেত।
  • যদি স্ত্রী বৈবাহিক চুক্তির নিয়ম ভাঙ্গে, তবে সে বিবাহবিচ্ছেদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়; এক্ষেত্রে সে তার প্রাপ্য বরপণ ও যৌতুক ফিরে পাওয়ার অধিকার হারাত।
  • স্বামী বিবাহবিচ্ছেদের কারণ হলে তবে শাস্তি হিসাবে স্ত্রীকে টাকা দিতে হত। বৈবাহিক চুক্তির অংশ ছিল: বিবাহবিচ্ছেদের সময়ে শাস্তির পরিমাণ কত, তা নির্ধারণ করা।
  • দ্বিতীয় বিবরণ ২৪:১-৪ পদ অনুসারে, বিবাহবিচ্ছেদ-প্রাপ্ত স্ত্রী পুনর্বিবাহ করলে এবং সেই দ্বিতীয় বিবাহও ভেঙ্গে গেলে, তবে প্রথম বিবাহের স্বামীকে পুনরায় বিবাহ করা করা নিষিদ্ধ। কেন এই আইনটি দেওয়া হয়েছিল?
  • উল্লিখিত শাস্ত্রাংশে একটি নির্দিষ্ট উদাহরণ দেওয়া হয়: ধরুন স্বামী “স্ত্রীর মধ্যে কোন দোষ দেখে” তার স্ত্রীকে বিবাহবিচ্ছেদ করে (যার অর্থ এই যে, সেই স্ত্রীটি বিবাহবিচ্ছেদের কারণ হওয়ায় বিচ্ছেদের সময় তার যৌতুক ফিরে পায় না)। আরো ধরুন পরবর্তীতে বিবাহবিচ্ছেদ-প্রাপ্ত স্ত্রী পুনর্বিবাহ করে এবং এই দ্বিতীয় বিয়েও ভেঙ্গে যায়। দ্বিতীয় স্বামী যদি তাকে ‘কারণ ছাড়া বিবাহবিচ্ছেদ’ করে, তাবে স্ত্রীটি তার দ্বিতীয় বিয়ের যৌতুক ফিরে পায়। এক্ষেত্রে স্ত্রীলোকটি যদি প্রথম স্বামীকে পুনর্বিবাহ করে, তবে স্বামীটি দ্বিতীয়বার যৌতুক পায়। স্বামী যেন দ্বিগুণ অর্থনৈতিক লাভের প্রলোভনে না পড়ে, সম্ভবত একারণে আইনটি দেওয়া হয়েছে।
  • কোন কোন বিবাহের চুক্তিতে বর ও কনে উভয়ের পাওনা টাকা সমান ছিল, কিন্তু তারপরেও তা চুক্তিতে লিপিবদ্ধ করা হত।
  • আশেপাশের দেশগুলো এবং ইস্রায়েলীয়েরা একমত ছিল যে, বিবাহিত ব্যক্তি ব্যভিচার করলে, সে বিবাহ ভাঙ্গার জন্য দায়ী। তাই এই বিষয়ে কারও দ্বিমত না থাকায়, বিবাহের চুক্তিতে বিবাহ ভাঙ্গার কারণ উল্লেখ থাকলেও সাধারণত ব্যভিচারের উল্লেখ করা হত না।
  • বৈবাহিক চুক্তির বিভিন্ন দলিলে উল্লিখিত শর্তগুলোর মধ্যে যা বেশি পাওয়া যায়, তা হল: দ্বিতীয় বিয়ে করলে প্রথম স্ত্রীর অধিকার কমানো যাবে না। এই শর্তটি বহুবিবাহ নিষেধ করে না কিন্তু প্রথম স্ত্রীর অধিকার সুরক্ষা করে।
  • স্বামীর দায়িত্ব ছিল ‘খাবার, তেল ও কাপড়ের’ যোগান দেওয়া। কিছু দলিলে ‘গম’ বা ‘টাকা’ উল্লেখ করা ছিল। এর সমান্তরাল শাস্ত্রাংশ হল যাত্রা ২১:১০-১১ পদ “সেই মনিব সেই দাসীকে বিয়ে করবার পরেও যদি অন্য কাউকে বিয়ে করে তবুও সে তার খোরাক-পোশাক দিতে বাধ্য থাকবে এবং দেহের দিক থেকে তার যা পাওনা তা-ও তাকে দিতে হবে। ১১ সে যদি এই সব কর্তব্য না করে তবে কোন টাকা না নিয়েই তাকে চলে যেতে দিতে হবে”“দেহের দিক থেকে পাওনা”, এর অর্থ কি? তা সম্পূর্ণ পরিষ্কার না।
  • ব্যভিচার করার শাস্তি ‘মৃত্যুদণ্ড’, এই বিষয়ে পুরাতন নিয়মের আইন এবং ঐসময়ের মধ্যপ্রাচ্য দেশের নিয়মের মধ্যে মিল রয়েছে। তবে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি সব সময় বিস্তার করা হত কিনা, এই বিষয়ে বেশি তথ্য নেই।
  • দ্বিতীয় বিবরণ ২৪:১ “যদি কেউ স্ত্রীর মধ্যে কোন দোষ দেখে”। ইংরেজি: “a matter of indecency”। এই বাক্য ঐযুগের মধ্যপ্রাচ্য দেশের দলিলে পাওয়া যায় না। এই ইব্রীয় শব্দের অনুবাদ সম্পূর্ণ পরিষ্কার না। এর আক্ষরিক অনুবাদ: ‘বিষয়ের উলঙ্গতা’। শব্দটি বাইবেলের মাত্র আর একটি পদে পাওয়া যায়, দ্বিতীয় বিবরণ ২৩:১৪: “ঈশ্বর সদাপ্রভু তোমাদের ছাউনির মধ্যে ঘুরে বেড়ান। সেইজন্য তোমাদের ছাউনি পবিত্র অবস্থায় রাখতে হবে যাতে তোমাদের মধ্যে জঘন্য কিছু দেখে তিনি তোমাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে না নেন।” এই পদে শব্দটি অনৈতিক কোন বিষয় বুঝায় না বরং তা আসলে ‘পায়খানা’ বুঝায়, অর্থাৎ ছাউনির মধ্যে নোংরা কিছু।

মোশির আইন-কানুন

  • ঐসময়ের মধ্যপ্রাচ্য দেশগুলোর নিয়ম বা আইনের চেয়ে মোশির আইন-কানুনের ভিন্নতা কোথায়?
  • ঐযুগের চারিদিকের দেশগুলোর মত মোশির আইন-কানুন বহুবিবাহ এবং বিবাহবিচ্ছেদ সম্বন্ধে নিষেধ করে না।
  • পুরাতন নিয়মে ঈশ্বরের আহবান-প্রাপ্ত অনেক ব্যক্তি রয়েছেন যারা বহুবিবাহ করেছিলেন (যেমন: অব্রাহাম, যাকোব, গিদিয়োন, শৌল, দায়ূদ, শলোমন ইত্যাদি) এবং যখন অব্রাহাম তার উপস্ত্রী হাগারের সাথে বিবাহবিচ্ছেদ করেন তখন ঈশ্বর অব্রাহামের সাথে এই বিষয়ে একমত ছিলেন (আদি ২১:১২)। এরপরেও পুরাতন নিয়ম দেখায় যে, একবিবাহ হল ঈশ্বর দ্বারা স্থাপিত ও সমর্থিত। একবিবাহ হল বৈবাহিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ। শুধুমাত্র প্রতিজ্ঞায় সমর্পিত ও বিশ্বস্ত বৈবাহিক সম্পর্ক ঈশ্বরের দৃষ্টিতে আদর্শ।
  • চারিদিকের দেশগুলোর তুলনায় মোশির আইন-কানুনে বিবাহবিচ্ছেদ-প্রাপ্ত স্ত্রীর অধিকার বেশি ছিল। যাত্রা ২১:১০-১১ অনুসারে, কোন দাসীকে বিয়ে করার পরে যদি বিবাহবিচ্ছেদ করা হয়, তবে তাকে মুক্ত হিসাবে ছেড়ে দিতে হবে এবং কোনো টাকা দাবি করা চলবে না।
  • দ্বিতীয় বিবরণ ২৪:১-৪ পদ অনুসারে, বিবাহবিচ্ছেদ করলে তবে স্ত্রীকে ত্যাগপত্র লিখে দিতে হবে (যেন বিচ্ছেদ প্রাপ্ত নারী পুনরায় বিয়ে করতে পারে)।
  • দ্বিতীয় বিবরণ ২২:১৩-১৮ পদ অনুসারে, বিয়ের পরে যদি স্বামী বিবাহবিচ্ছেদের জন্য মিথ্যাভাবে কোনো কারণ তৈরী করে, সেক্ষেত্রে স্ত্রী ও তার পরিবারের করণীয় কি, সে বিষয়ে এই পদে সমাধান রয়েছে। এ থেকে বোঝা যায় যে, উপযুক্ত কারণ না থাকলে বিবাহ বিচ্ছেদ করা সম্ভব ছিল না অথবা তা তারপরেও করলে তবে অনেক জরিমানা দিতে হত।
  • কি কি কারণে বিবাহবিচ্ছেদ করা সম্ভব ছিল, এ বিষয়ে মোশির আইন-কানুনে সরাসরি উল্লেখ নেই। এছাড়াও কোন কোন ক্ষেত্রে স্ত্রীর যৌতুক ফিরে পাওয়ার অধিকার ছিল এবং সন্তানদের উত্তরাধিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে কি কি নিয়ম ছিল, এ বিষয়গুলোও উল্লেখ নেই।
  • চারিদিকের দেশে প্রচলিত নিয়ম অনুসারে স্বামী ব্যভিচার করলে তবে বিবাহটিকে বিচ্ছেদ করা বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু মোশির আইন-কানুন অনুসারে এক্ষেত্রে স্ত্রীর বিবাহ না ভাঙ্গার অধিকার ছিল। স্ত্রী যদি বিবাহ ভাঙ্গতে না চাইত, তবে এভাবে বিবাহ রক্ষা করা সম্ভব ছিল।
  • এছাড়া মোশির আইন-কানুন অনুসারে স্ত্রীকে বিচ্ছেদ করলে তবে তাকে ত্যাগ-পত্র দেওয়া স্বামীর জন্য বাধ্যতামূলক ছিল। ত্যাগ-পত্র পাওয়া স্ত্রীর জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল কারণ ত্যাগ-পত্র ছাড়া সে আইনগতভাবে পুনরায় বিবাহ করতে পারত না। মোশির আইন-কানুন এভাবে নিশ্চিত করে একটি বিবাহবিচ্ছেদ-প্রাপ্ত স্ত্রীর যেন পুনরায় বিবাহ করার এবং এভাবে নতুন জীবন শুরু করার অধিকার আছে।
  • মোশির আইন-কানুন অনুসারে স্ত্রীদের কিছু ক্ষেত্রে বিবাহবিচ্ছেদ দাবি করার অধিকারও ছিল।
বিবাহের ক্ষেত্রে এবং বিবাহবিচ্ছেদে নারী অধিকার
  • মোশির সময়ে মধ্যপ্রাচ্য দেশগুলোতে বিবাহবিচ্ছেদের বিষয়ে বিভিন্ন ধরণের আইন প্রচলিত ছিল। যেমন: একটি প্রচলিত আইন অনুসারে, সেই সময়ে নারীদের বিবাহবিচ্ছেদ করার কোন অধিকার ছিল না। আর একটি আইন অনুসারে, স্বামী গুরুতর কোনো ভুল করলে, শুধুমাত্র এক্ষেত্রে নারীর বিবাহবিচ্ছেদের অধিকার ছিল। কিন্তু যদি মামলার রায় নারীর বিরুদ্ধে যেত, সেক্ষেত্রে নারীর মৃত্যুদণ্ড হতে পারত। এছাড়াও অন্যতম একটি আইন অনুসারে, বৈবাহিক জীবনে যদি স্বামী তাকে অবহেলা করত, সেক্ষেত্রেও নারীর বিবাহবিচ্ছেদের অধিকার ছিল।
  • হাম্মুরাবি আইন-কানুন (Hammurabi Law Code) অনুসারে, যুদ্ধে স্বামী বন্দী হওয়ায় দীর্ঘ সময় স্বামীর অনুপস্থিতির কারণে স্ত্রী যদি অভাবে পড়ে, তবে স্ত্রীর পুনর্বিবাহের অনুমতি ছিল। কিন্তু বন্দীত্ব থেকে মুক্ত হয়ে স্বামী ফিরে এলে, তবে স্ত্রীকে তার দ্বিতীয় স্বামী ছেড়ে প্রথম স্বামীর কাছে ফিরে যেতে হত। যদি স্ত্রীকে অবহেলা করা হত, তবে ৫ বছর পর তার বিবাহবিচ্ছেদ দাবি করার অধিকার থাকত। এই আইন অনুসারে, নারীকে ৫ বছর ধরে অনাহারে থাকতে অথবা পিতার দয়ার উপর নির্ভর করতে হত।
  • এর তুলনায় মোশির আইন-কানুন অনেক অনুগ্রহ দেয়, কারণ এখানে এই বিষয়ে সময়ের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। যাত্রা ২১:১০-১১ অনুসারে, একজন অবহেলিত স্ত্রী বিবাহবিচ্ছেদ দাবি করতে পারত। যদিও প্রকৃতপক্ষে এ আইনটি একজন দাসী-স্ত্রী সম্বন্ধীয়, তবুও যিহূদী রব্বীরা এ আইনটি সব নারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য মনে করত, ধারণা করা হত যে, একজন দাসী স্ত্রীর এই অধিকার থাকলে তবে একজন স্বাধীন স্ত্রীরও একই অধিকার নিশ্চয় ছিল।
বিবাহবিচ্ছেদ আবশ্যিক নয়, অর্থাৎ স্ত্রী বিবাহবিচ্ছেদ অগ্রাহ্য করতে পারে
  • যদি একজন স্ত্রীর বিরুদ্ধে ভুল ব্যবহার করা হয় (যেমন ব্যভিচার, অবহেলা) তবে স্ত্রীর বিবাহবিচ্ছেদ করা আবশ্যক, এমন নয়। মধ্য প্রাচ্যের অন্য দেশগুলোতে বাধ্যতামূলক বিবাহবিচ্ছেদ প্রচলিত ছিল।
  • ধর্ষণের ক্ষেত্রে, ঐসময়ের মধ্যপ্রাচ্য দেশের আইন অনুসারে, দোষী পুরুষকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত কিন্তু নারীকে কোন শাস্তি দেওয়া হত না। তবুও এই ধরণের নারীদের পুনর্বিবাহের সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে কমে যেত, এমন কি পুনর্বিবাহ সংঘটিত হলেও দেনমোহর যথেষ্ট কমানো হত।
  • দ্বিতীয় বিবরণ ২২:২৮-২৯ পদ অনুসারে, যদি কোন পুরুষ কুমারী মেয়েকে ধর্ষণ করে, তবে জরিমানা সহ অবশ্যই সেই মেয়েকে বিবাহ করতে হবে এবং পরবর্তীতে কখনও বিবাহবিচ্ছেদ করা যাবে না। এভাবে নারী অধিকার ও যোগান নিশ্চিত করা হয়।
  • হাম্মুরাবি আইন-কানুন অনুসারে, যদি বিবাহ করার পরে কোন নারীর শরীরে রোগ দেখা যায় (কি ধরণের রোগ, এর বর্ণনা দেওয়া হয় নি), তবে সেই নারীকে বিবাহবিচ্ছেদ করে ছেড়ে দেওয়ার অনুমতি নেই।
  • মোশির আইন-কানুনে রোগের বিষয়ে কোনো আইন পাওয়া যায় না্, এছাড়াও যিহূদী ঐতিহ্য অনুসারে, যদি কোন বিবাহিত নারী ‘পাগল’ হয়ে যেত, তবে তাকে বিবাহবিচ্ছেদের দ্বারা ছেড়ে দেওয়ার অনুমতি ছিল না।
  • দ্বিতীয় বিবরণ ২২:১৩-১৮ পদ অনুসারে, বিবাহের পরে যদি স্বামী তার স্ত্রীর বিষয়ে দোষারোপ করে বলে যে, সে কুমারী বা সতী ছিল না এবং তা সত্য প্রমাণিত হলে, তবে বিবাহবিচ্ছেদ করা সম্ভব ছিল। অন্যথায়, দোষারোপটি মিথ্যা হিসাবে প্রমাণিত হলে জরিমানা সহ চিরতরে সেই স্ত্রীকে বিবাহবিচ্ছেদ বা ত্যাগ করার অধিকার স্বামী হারাত।
  • ইতিহাসবিদ ফিলো (Philo) এবং যোষিফাস ফ্লাভিয়াস্ (Josephus Flavius)-এর লেখা থেকে এই সারাংশে আসা যায় যে, ধর্ষণের পরে পুরুষ নারীটিকে বিবাহ করবে কিনা, এই সিদ্ধান্ত একমাত্র নারীই নিতে পারত। একইভাবে পুরুষের দেহে রোগ থাকলেও বিবাহের সিদ্ধান্ত একমাত্র নারীর ছিল।
বিবাহবিচ্ছেদে ত্যাগপত্র পেতে ও পুনরায় বিবাহ করতে নারী অধিকার
  • গণনা ৩৬:৬ পদে বিবাহের সিদ্ধান্তে নারী অধিকার সম্বন্ধীয় উল্লিখিত এই কথা “যাকে খুশী তাকে বিয়ে করতে পারে”, তা যিহূদীদের বিভিন্ন বিবাহের চুক্তি ও বিবাহবিচ্ছেদের দলিলে পাওয়া যায়।
  • দ্বিতীয় বিবরণ ২৪:১-৪ দাবি করে যে, স্বামী যদি স্ত্রীকে বিবাহবিচ্ছেদ করে তবে তাকে অবশ্যই ত্যাগপত্র দিতে হবে। এই ধরণের নিয়ম ঐযুগের মধ্যপ্রাচ্য দেশগুলোর আইন-কানুনে নেই। সেখানে মাত্র একটি বিষয় উল্লেখ করা আছে: যুদ্ধে বন্দী হওয়ার ২ বছর পর্যন্ত স্বামীর অনুপস্থিতিতে স্ত্রীর ‘বিধবা হওয়ার প্রমাণ পত্র’ পাওয়ার অধিকার ছিল।
  • বিবাহবিচ্ছেদ-প্রাপ্ত নারীর জন্য এই ত্যাগপত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল কারণ এছাড়া তার জন্য নৈতিকভাবে ও আইনগতভাবে নতুন বিয়ে করা সম্ভব ছিল না। ত্যাগপত্র ছাড়া নতুন বিয়ে করলে তাকে ব্যভিচারী হিসাবে ধরা হত এবং তা ছিল মৃত্যুদণ্ড যোগ্য অপরাধ। পুরুষদের ক্ষেত্রে ত্যাগপত্র তেমন দরকার ছিল না কারণ পুরুষদের বহুবিবাহ করার অনুমতি ছিল, অর্থাৎ প্রথম স্ত্রীকে আইনগত ভাবে বিবাহবিচ্ছেদ না করলেও সে নতুন বিবাহ করতে পারত। তাকে এবিষয়ে কোন দোষ দেওয়া যেত না।
  • মোশির আইন-কানুন অনুসারে, বিধবাদের পুনরায় বিয়ে করার অধিকার ছিল।
  • এছাড়া দ্বিতীয় বিবরণ ২৫:৫-৯ অনুসারে কোন স্বামী যদি (ছেলে) সন্তান না রেখে মারা যেত, তবে বিধবার মৃত স্বামীর ভাইকে বিবাহ করার অধিকার ছিল। এই নিয়মের উদ্দেশ্য ছিল – বিধবার জন্য বৃদ্ধ বয়সে ভরণ-ভোষণের যোগান নিশ্চিত করা।
  • ঐযুগের মধ্যপ্রাচ্যের নিয়ম অনুসারে, স্বামীর অবহেলার কারণে স্ত্রী চলে গেলেও, ৫ বছরের মধ্যে সেই স্ত্রীকে বলপ্রয়োগে পুনরায় দাবি করার অধিকার স্বামীর ছিল। এমনকি অবহেলিত স্ত্রী চলে গিয়ে পুনর্বিবাহের দ্বারা সন্তান জন্মদান করলেও, সেই সন্তানসহ স্ত্রীকে দাবি করার অধিকার প্রথম স্বামীর ছিল! এই কঠোর নিয়মের কারণে অবহেলিত স্ত্রীর জন্য পুনরায় বিয়ে করা আরো কঠিন ছিল, কারণ নতুন স্বামীকে এই ঝুঁকির সম্মুখীন হতে হত।
  • এর তুলনায় দ্বিতীয় বিবরণ ২৪ নারীদের অধিকার সুরক্ষায় বেশি সাহায্য করে: যদি একজন নারী বিবাহবিচ্ছেদ প্রাপ্ত হয়, তবে সেই নারীর উপরে আগের স্বামীর আর কোন অধিকার থাকে না। এর ফলে দ্বিতীয় স্বামীর আর কোন ভয় হত না যে, আগের স্বামী সেই নারীকে পুনরায় দাবি করবে। স্ত্রীকে বিবাহবিচ্ছেদের দ্বারা ত্যাগ করা মানে তার উপর সমস্ত অধিকার হারানো।
  • ‘বিবাহবিচ্ছেদ করলে ত্যাগপত্র দিতে হবে’ এই সুরক্ষাকারী আইন বিপরীতভাবে নারীদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ব্যবহার করা হত, যা অত‍‍্যন্ত দুঃখের বিষয় ছিল। একজন স্বামী যদি স্ত্রীকে ত্যাগপত্র দিতে প্রত্যাখ্যান করত তবে সেই নারী সমস্যায় পড়ত। স্বামীর সমস্যা হত না, কারণ তার বহুবিবাহ করার অধিকার ছিল।
  • ত্যাগপত্র না পাওয়ার কারণে আটকিয়ে যাওয়ার সমস্যা এমন নারীদের হত, যাদের স্বামী নিখোঁজ হত (যেমন: যুদ্ধের পরে নিখোঁজ সেনা বা ব্যবসায়ী যিনি পরবর্তীতে আর ফিরে আসেন না)।
    গীত ১৩২:১৩-১৬ “সদাপ্রভু সিয়োনকে বেছে নিয়েছেন; তাঁর বাসস্থানের জন্য এটাই তিনি চেয়েছিলেন। ১৪ তিনি বলেছিলেন, ‘এটাই আমার চিরকালের বিশ্রামের স্থান; আমি এখানেই বাস করব, কারণ আমি তা-ই চেয়েছি। আমি সিয়োনকে প্রচুর খাবার দিয়ে আশীর্বাদ করব; খাবার দিয়ে সেখানকার গরীব লোকদের তৃপ্ত করব। আমি … পুরোহিতদের উদ্ধারের পোশাক পরাব; … ভক্তেরা আনন্দে জোরে জোরে গান করবে।”
  • এখানে ইস্রায়েলের সঙ্গে ঈশ্বরের চুক্তি স্বামী-স্ত্রীর বৈবাহিক সম্পর্কীয় রূপক দিয়ে বর্ণিত। তবুও বলতে হয় যে, স্বামী-স্ত্রীর বৈবাহিক চুক্তি হল সমমর্যাদার চুক্তি (parity covenant), কিন্তু ইস্রায়েলের সাথে ঈশ্বরের চুক্তি হল অধিরাজ-সামন্ত চুক্তি (suzerainty covenant)।

পরের ভাববাদীরা

ঈশ্বরের সঙ্গে আবদ্ধ চুক্তি ইস্রায়েল ভেঙ্গেছে
  • যাত্রাপুস্তক বর্ণনা করে যে, ঈশ্বর কিভাবে ইস্রায়েল জাতিকে তাঁর নিজের কাছে নিয়ে আসেন (যাত্রা ১৯:৪), তিনি সেই জাতির সাথে চুক্তি স্থাপন করে তাদের একমাত্র ঈশ্বর হতে চান এবং তাদেরকে ‘নিজের লোক’ হিসাবে গ্রহণ করেন (যাত্রা ১৯:৪-৬, ২৯:৪৫)।
  • ঈশ্বরকে “স্বগৌরব রক্ষণে উদ্যোগী ঈশ্বর” বলা হয় (যাত্রা ২০:৫, ৩৪:১৪ “আমার পাওনা ভক্তি আমি চাই। কারণ সদাপ্রভুর নাম হল পাওনা ভক্তি পাবার আগ্রহী ঈশ্বর; তিনি তাঁর পাওনা ভক্তি চান” কেরী: “তুমি অন্য দেবতার কাছে প্রণিপাত করিও না, কেননা সদাপ্রভু স্বগৌরব রক্ষণে উদ্যোগী নাম ধারণ করেন; তিনি স্বগৌরব রক্ষণে উদ্যোগী ঈশ্বর”)। তিনি অধিকারগত ও উপযুক্তভাবে ইস্রায়েলের একমুখী ভক্তি দাবি করেন।
  • ভাববাদী হোশেয় এবং পরবর্তী ভাববাদী যিশাইয়, যিরমিয় ও যিহিষ্কেল এই রূপক ব্যবহার করেন: ঈশ্বর হলেন পরিত্যাক্ত ও বিশ্বস্ত স্বামী এবং ইস্রায়েল হল অবিশ্বস্ত, অর্থাৎ বৈবাহিক চুক্তি ভঙ্গনকারী স্ত্রী। ইস্রায়েল অন্য দেবতা এবং অন্য জাতিগুলোর সাথে লজ্জাহীনভাবে ব্যভিচার করেছে, তাই ঈশ্বর বাধ্য হয়ে ইস্রায়েলকে ত্যাগ করেন। বৈবাহিক সম্পর্ক ভাঙ্গার সম্পূর্ণ দোষ ইস্রায়েলের।
  • ইস্রায়েলকে এভাবে ত্যাগ করার বিষয় বিভিন্ন ভাবে প্রকাশিত: “তোমরা আমার লোক নও এবং আমিও তোমাদের ঈশ্বর নই” (হোশেয় ১:৯), যা হল যাত্রা ২৯:৪৫ এর বিপরীত কথা। “সে আমার স্ত্রী নয় এবং আমিও তার স্বামী নই” (হোশেয় ২:২)। হতে পারে, এই একই কথা ঐযুগের বিবাহবিচ্ছেদের পত্রে অর্থাৎ ত্যাগ-পত্রে ব্যবহৃত হত। বিবাহবিচ্ছেদের বিষয় এই পদেও প্রকাশিত: “সে তার প্রেমিকদের পিছনে দৌড়াবে কিন্তু তাদের ধরতে পারবে না; সে তাদের খুঁজবে কিন্তু পাবে না। তখন সে বলবে, ‘আমি আমার প্রথম স্বামীর কাছে ফিরে যাব, কারণ তখন আমি এখনকার চেয়ে ভাল ছিলাম” (হোশেয় ২:৭) এবং “তাদের মা ব্যভিচার করেছে; যে তাদের গর্ভে ধরেছে সে লজ্জার কাজ করেছে। সে বলত, ‘আমি আমার প্রেমিকদের পিছনে যাব; তারাই আমাকে খাবার, জল, পশম, মসীনা, তেল ও পানীয় দিয়ে থাকে” (হোশেয় ২:৫), যা যাত্রা ২১:১০-১১ পদের সমান্তরাল কথা।
  • ঈশ্বর কখনও এই বিচ্ছেদ চান নি, ইস্রায়েল লজ্জাহীনভাবে চুক্তি ভাঙ্গার আচরণ এবং অনুতপ্ত হওয়ার বাণী প্রত্যাখ্যান করার মধ্য দিয়ে বিচ্ছেদটি ঘটায়।
  • এই দুঃখজনক বাণীর বিপরীতে হোশেয় একটি অবিশ্বাস্য ও অতি দয়ার আশাবাণীও দেন: একদিন ইস্রায়েল ও যিহূদা আবার এক হবে এবং ঈশ্বর এই ‘কন্যা’-কে পুনরায় গ্রহণ করবেন (হোশেয় ২:১৯-২০)।
  • ভাববাদী হোশেয় এবং যিশাইয় উভয়েই ইস্রায়েলের দেবতাপূজা (হোশেয় ২:১৩) এবং অন্য জাতিদের সাথে তাদের রাজনৈতিক মৈত্রীচুক্তিকে ‘ব্যভিচার’ বলে আখ্যায়িত করেন (হোশেয় ৫:১৩)। যখন যিশাইয় ইস্রায়েলকে আশা বাণী দেন তিনি প্রশ্ন করেন: ইস্রায়েলের ত্যাগপত্র কোথায়? (যিশাইয় ৫০:১)।
  • যিরমিয় যখন অবিশ্বস্ত যিহূদাকে চেতনা দিতে চেষ্টা করেন, তখন তিনি তাকে ‘অবিশ্বস্ত ইস্রায়েলের অবিশ্বস্ত বোন’ বলে সম্বোধন করেন (যিরমিয় ৩:৭) এবং দ্বিতীয় বিবরণ ২৪:১-৪ পদে উল্লিখিত বিবাহবিচ্ছেদের আইন উদ্ধৃতি করেন (যিরমিয় ৩:১)।
  • যিহিষ্কেল ইস্রায়েলকে একটি অসহায় পরিত্যাক্ত কন্যা হিসাবে বর্ণনা করেন, যাকে ঈশ্বর নিজেই দত্তক নিয়েছিলেন। তাঁর যত্নে মেয়েটি সুন্দর কনেতে পরিণত হয় কিন্তু বড় হয়ে সে ঈশ্বরকে ত্যাগ করে ব্যভিচার করে (যিষ্কিয়েল ৬)। যিহিষ্কেল ইস্রায়েল ও যিহূদাকে দু’জন বোনের সাথে তুলনা করেন যারা বিবাহের চুক্তি ভেঙ্গে ব্যভিচার করে (যিহিষ্কেল ২৩)।
মালাখি ২:১৩-১৬ বৈবাহিক চুক্তি ভাঙ্গা, অবিশ্বস্ততা ও বিবাহবিচ্ছেদ ঈশ্বর ঘৃণা করেন

“আর একটা খারাপ কাজ তোমরা করে থাক; সেটা হল, চোখের জলে তোমরা সদাপ্রভুর বেদী ভাসাও। তোমরা কান্নাকাটি ও বিলাপ কর, কারণ তোমরা যা দাও তার প্রতি তিনি আর মনোযোগ দেন না কিম্বা খুশী মনে তোমাদের হাত থেকে তা গ্রহণও করেন না। ১৪ তোমরা বলছ, “কেন করেন না?” এর কারণ হল, সদাপ্রভু তোমাদের প্রত্যেক লোকের ও তার যৌবনকালের স্ত্রীর বিয়ের সাক্ষী হয়েছিলেন; কিন্তু যদিও সেই স্ত্রী তার সংগী, তার বিয়ের চুক্তি করা স্ত্রী, তবুও সে তার সংগে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। ১৫ সদাপ্রভু কি স্বামী ও স্ত্রীকে এক করেন নি? দেহে ও আত্মায় তারা তাঁরই। তারা কেন এক? কারণ তিনি তাদের মধ্য দিয়ে একটা ঈশ্বরভক্ত বংশ রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। কাজেই তোমরা তোমাদের অন্তরের বিষয়ে সাবধান হও; যৌবনকালের স্ত্রীর সংগে তোমরা বিশ্বাসঘাতকতা কোরো না। ১৬ ইস্রায়েলের ঈশ্বর সদাপ্রভু বলছেন, “আমি স্ত্রীকে ত্যাগ করা ঘৃণা করি।” এছাড়া সর্বক্ষমতার অধিকারী সদাপ্রভু বলছেন, “যে লোক কাপড় পরবার মত করে নিজেকে অত্যাচার দিয়ে সাজায় তার সেই কাজ আমি ঘৃণা করি। কাজেই তোমরা তোমাদের অন্তরের বিষয়ে সাবধান হও, বিশ্বাসঘাতকতা কোরো না।”

  • ‘ধার্মিক হওয়া বা প্রকৃত ধার্মিকতা’ কি? মালাখি এই পদগুলোতে এর ভিন্ন একটি সংজ্ঞা দেন: কেবলমাত্র উৎসর্গ দান, উপবাস-প্রার্থনা বা কান্নাকাটি করার অর্থ-ই ধার্মিকতা নয় বরং নিজের স্ত্রীর প্রতি বিশ্বস্ত হওয়া ও ন্যায্য ব্যবহার করা হল প্রকৃত ধার্মিকতা। বৃদ্ধ বয়সে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় স্ত্রীর যৌবনের সৌন্দর্য বিলুপ্ত হওয়ার কারণে যে সব স্বামীরা প্রলোভিত হয়ে যুবতী মেয়েদের দিকে আকৃষ্ট হয়, মালাখি এমন স্বামীদেরকে “যৌবনকালের স্ত্রীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা” না করতে কড়া নির্দেশ দেন।
  • যৌন সম্পর্ক যে, ‘শারীরিক বিষয় মাত্র’, এমন নয়, বরং আত্নারও। দেহ, আত্মা ও প্রাণ আলাদা করা যায় না। যৌন সম্পর্ক সব ক্ষেত্রে একটি একতা সৃষ্টি করে। একারণে ব্যভিচার বা বিচ্ছেদ দিয়ে বৈবাহিক সম্পর্ক ভাঙ্গার অর্থ হল- ধারালো ছুঁরি দিয়ে মাংস কেটে আলাদা করার মত, যা মালাখি ২:১৬ পদে অত্যাচার বা হিংস্রতার সাথে তুলনা করা হয়েছে।
  • বিবাহবিচ্ছেদ হল একটি চরম বিশ্বাসঘাতকতা, গভীর ক্ষতি এবং সর্বক্ষেত্রে একসাথে আঘাত করা। ঈশ্বর তা ঘৃণা করেন এবং কারও বিরুদ্ধে এমন অন্যায় করা হোক, তা তিনি চান না।
  • এখানে পার্থক্য দেখানো হয়েছে: ইস্রায়েলের অবিশ্বস্ততা এবং ঈশ্বরের বিশ্বস্ততার বিষয়ে – তিনি আমাদের ত্যাগ করবেন না, তিনি নিজের প্রতিজ্ঞা ভাঙ্গবেন না। আমাদেরকে তার মত হতে হবে।
  • মালাখি স্বামী-স্ত্রীর বিবাহবিচ্ছেদের বিষয়ে কথা বলেন, এছাড়াও তিনি সেই সব লোকদের বিষয়ে বলেন: যারা নির্বাসন থেকে ফিরে এসে দেবতাপূজারী স্ত্রীদের বিয়ে করে (মালাখি ২:১১-১২) এবং যারা দশমাংশ দেয় না (মালাখি ৩:৮-১০), যারা “যাদুকর, ব্যভিচারী, মিথ্যা সাক্ষী এবং যারা মজুরদের মজুরিতে ঠকায়, যারা বিধবা ও অনাথদের অত্যাচার করে আর বিদেশীদের ন্যায়বিচার পেতে দেয় না, অর্থাৎ যারা আমাকে ভয় করে না” (মালাখি ৩:৫)। এসব আচরণের অর্থ হল ‘ঈশ্বরের চুক্তি’ ভাঙ্গা।
  • মালাখি ৩:১৬ পদ বলে যে, ঈশ্বর “স্ত্রীকে ত্যাগ করা ঘৃণা” করেন। হয়তো মালাখি সেই সময়ে ত্যাগপত্রে ব্যবহৃত প্রচলিত উক্তির সাথে সামঞ্জস্য রেখে তা ঘোষণা করেন, যেখানে স্বামী ঘোষণা করত যে, সে ‘স্ত্রীকে ঘৃণা করে ও তাই বিবাহবিচ্ছেদ করে’। এই কথাগুলো একটি ‘কারণ ছাড়া বিবাহবিচ্ছেদে’ (no-grounds-divorce) ব্যবহার করা হত (দ্বিতীয় বিবরণ ২২:১৩, ২৪:৩ “অপছন্দ করে” > বিবাহবিচ্ছেদ)।
  • আমরা সাধারণত এই পদ থেকে উপসংহারে আসি যে, বিবাহবিচ্ছেদ করা কখনও ঠিক নয়। যদি একজন নির্যাতিত স্ত্রী আমাদের পরামর্শ চায়, তবে আমরা তাকে বৈবাহিক সম্পর্ক রক্ষা করতে বলি এবং নির্যাতন ‘সহ্য’ করতে বলি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বর কথাটি পরিত্যাক্ত স্ত্রীকে বলেন না বরং চুক্তি ভঙ্গকারী স্বামীকে বলেন যেন সে বিবাহের চুক্তি, অর্থাৎ বিবাহের দিনের শপথ ভেঙ্গে না দেয়, যেন সে তার যৌবনকালের স্ত্রীর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা না করে!
  • আমরা ধরি, যার বিরুদ্ধে অন্যায় করা হয়। ঈশ্বর ধরেন, যে খারাপ আচরণ করে। আমরা শিকারকে ধরি, ঈশ্বর অন্যায়কারীকে ধরেন। আমরা বলি: সহ্য কর! বিবাহবিচ্ছেদ করবে না! ঈশ্বর বলেন: যে প্রথমে বিবাহের শপথ ভাঙ্গে, তাকে ধরা দরকার কারণ সে ব্যভিচার করে, বিশ্বাস ভাঙ্গে, নির্যাতন করে এবং অবহেলা করে। “ঈশ্বর স্ত্রীকে ত্যাগ করা ঘৃণা করেন” এই কথার অর্থ এই নয় যে, বিবাহবিচ্ছেদ করা কখনও প্রয়োজন হবে না। “ঈশ্বর স্ত্রীকে ত্যাগ করা ঘৃণা করেন” এর অর্থ হল: তুমি কখনও বিবাহ ভাঙ্গার কারণ হয়ো না! কিন্তু যদি তোমার বিরুদ্ধে অনবরত অন্যায় করা হয় তবে হয়তো বিবাহবিচ্ছেদ করা প্রয়োজন হবে।
  • যীশুর সমসাময়িক কুমরানের এসীন মনিরীষী গুরুরা, যারা সর্বপ্রথমে বহুবিবাহ নিষেধ করত, তারা বিবাহবিচ্ছেদ এবং পুনরায় বিবাহ করার বিষয়ে কারও দোষ ধরত না।
  • গ্রীস এবং রোম সংস্কৃতির শুরুর দিকে (প্রায় ৫০০-৩০০ খ্রীঃপূঃ) নারীরা সম্পূর্ণভাবে স্বামীর অধীনে ছিল, একারণে নারীদের ক্ষেত্রে বিবাহবিচ্ছেদ করার কোন উপায় ছিল না। পরবর্তীতে এই নিয়ম একটু শিথিল হলেও যীশুর সমসাময়িক রোম সম্রাট আগস্ত ১৮ খ্রীষ্টপূর্বে তা আবার বিস্তার করতে চেষ্টা করেন।
  • যিহূদা এলাকার বাইরে বসবাসকারী যিহূদী নারীদের বিবাহবিচ্ছেদ করার অধিকার তুলনামূলকভাবে বেশি ছিল (২০০ খ্রীঃপূঃ থেকে ১০০ খ্রীঃ) কারণ সেই সময়ে বৈবাহিক সম্পর্ক উভয়ের পারস্পরিক সম্মতি হিসাবে দেখা হত (mutual consent)। যখন পারস্পরিক সম্মতি ভেঙ্গে যেত, তখন বৈবাহিক সম্পর্কের অবসান হত। স্বামী অথবা স্ত্রী বিবাহবিচ্ছেদ করতে চাইলে তা জরিমানা ছাড়া বাস্তবায়ন করা সম্ভব ছিল। এক্ষেত্রে, স্ত্রী যদি ব্যভিচারের ফলে বিবাহবিচ্ছেদের কারণ হত, তবে সে যৌতুক হারাত। অথবা, ব্যভিচারের ফলে স্বামী বিবাহবিচ্ছেদের কারণ হলে, তবে বিবাহবিচ্ছেদের সময় স্ত্রীকে যৌতুকের দেড় গুন পরিমাণ জরিমানা দিতে হত। কিন্তু ব্যভিচার তখনও একটি লজ্জার বিষয় ছিল। কেউ কেউ দাবি করত যে, ব্যভিচার হলে তবে বিবাহবিচ্ছেদ আবশ্যক।
    • ৫০০ খ্রীষ্টাব্দে মিসরে বসবাসকারী যিহূদী নারী ও পুরুষের অধিকারের মধ্যে প্রায় সমতা ছিল, যেমন: মৌখিকভাবে বিবাহবিচ্ছেদ করার ক্ষেত্রে, উত্তরাধিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে, বৈবাহিক বিষয়ে অধিকারের ক্ষেত্রে এবং একবিবাহ দাবি করার ক্ষেত্রে। গ্রীক ও রোমীয় সংস্কৃতি বা আইন অনুসারে, যদি কোনো স্ত্রী ঘর থেকে বের হয়ে চলে যেত অথবা যদি স্ত্রীকে ঘর থেকে বের করে দেওয়া হত, তবে তা বিবাহবিচ্ছেদ হিসাবে ধরা হত। কিন্তু যিহূদী আইন অনুসারে, তা বিবাহবিচ্ছেদ হিসাবে ধরা হত না।
    • যিহূদীদের ক্ষেত্রে নারীর অধিকার ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়, যদিও কেবলমাত্র পুরুষের ত্যাগ-পত্র লেখার অধিকার ছিল। তবুও পুরুষেরা ত্যাগ-পত্র দিতে অনিচ্ছুক হলে তবে তাকে আদালতে এনে ত্যাগ-পত্র লিখতে বাধ্য করানো হত।
    • শিমিয়োন বিন সেটা (Simeon ben Shetah) নামে একজন যিহূদী রব্বী স্ত্রীকে বিবাহবিচ্ছেদ করতে নিরুৎসাহিত করতে বিভিন্ন জরিমানা বিস্তার করেন। তবুও কিছু ধনী পুরুষ তার এই প্রচেষ্টা অজুহাত হিসাবে ব্যবহার করত এই বলে করে যে, যথেষ্ট টাকা দিলে তবে বিচ্ছেদের বিরুদ্ধে আর আপত্তি উঠানো যাবে না।

যিহূদী রব্বীদের শিক্ষা: বিবাহবিচ্ছেদের জন্য গ্রহণযোগ্য কারণ

  • যীশুর জন্মের একটু আগে থেকে যিহূদীদের মধ্যে প্রচলিত চিন্তার অনুশীলন ছিল এই: বিবাহবিচ্ছেদের গ্রহণযোগ্য কারণ হল- নিঃসন্তান হওয়া, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অবহেলা, আবেগ বা সম্পর্কে অবহেলা (যাত্রা ২১:১০-১১) এবং ব্যভিচার। সেই সময় সাধারণত বলা হত যে, বিবাহবিচ্ছেদ ভাল না, তবে কিছু ক্ষেত্রে তা প্রয়োজন হতে পারে। স্বামী বিবাহবিচ্ছেদ করতে চাইলে, তবে সে ত্যাগপত্র লিখে বিবাহবিচ্ছেদ বাস্তবায়ন করতে পারত। কিন্তু স্ত্রী বিবাহবিচ্ছেদ করতে চাইলে, তবে আদালতে গিয়ে স্বামীকে ত্যাগপত্র লেখাতে বাধ্য করাতে হত। বিবাহবিচ্ছেদের পরে পুনরায় বিবাহ করা অধিকাংশ লোক গ্রহণযোগ্য মনে করত, একারণে ত্যাগপত্র প্রয়োজন, অন্যথায় তা ব্যভিচার হিসাবে দেখা হত। বৈবাহিক চুক্তি লঙ্গনকারীর প্রতি জরিমানা আরোপের বিষয়ে প্রত্যেকে একমত ছিল।
  • নারীরা ‘কারণ ছাড়া বিবাহবিচ্ছেদে’ স্বামীদের বাধ্য করাতে পারত না, কিন্তু পুরুষেরা ‘কারণ ছাড়া বিবাহবিচ্ছেদে’ স্ত্রীদের বাধ্য করাতে পারত। তবে ‘বিশেষ কারণ’ থাকলে নারীরা আদালতের সাহায্যে স্বামীদের জরিমানা সহ বিবাহবিচ্ছেদে বাধ্য করাতে সক্ষম হত এবং কিছু ক্ষেত্রে শারীরিক শাস্তিও দেওয়া হত।
  • দ্বিতীয় বিবরণ ২৪:১ পদের ব্যাখ্যা নিয়ে যিহূদী রব্বীদের মধ্যে দ্বিমত ছিল। রব্বী শাম্মা (Shamma) বলতেন যে, যাত্রাপুস্তক থেকে আসা ‘মাত্র ৪টি কারণের ক্ষেত্রে বিবাহবিচ্ছেদ গ্রহণযোগ্য’। আবার রব্বী হিল্লেল (Hillel) বলতেন, ‘যে কোন কারণে’ বিবাহবিচ্ছেদ করা যায়।
বিবাহবিচ্ছেদের কারণ হিসাবে ‘বন্ধ্যাত্ব বা নিঃসন্তান হওয়া’
  • যিহূদী রব্বীরা আদি ১:২৮ পদের ব্যাখ্যায় বলতেন যে, বৈবাহিক জীবনে সন্তান জন্মদান আবশ্যক ও বাধ্যতামূলক, এমনকি বিবাহের একমাত্র উদ্দেশ্য হল ‘সন্তান জন্মদান করা’। বিবাহের দ্বারা বংশবৃদ্ধি না করা যিহূদীদের কাছে মাত্র দুই ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য ছিল: ঈশ্বরের বাক্য অধ্যয়নরত বা ধ্যানের জীবন-যাপন করা অথবা কঠোর অর্থনৈতিক দুরাবস্থায় পড়া।
  • বিবাহের ১০ বছরের মধ্যে যদি কোনো সন্তানের জন্ম না হত, তবে বিবাহবিচ্ছেদ এবং পুনরায় বিবাহ সাধারণ বিষয় হিসাবে মনে করা হত। সম্ভবত, এই নিয়ম খুব কম-ই কার্যকর করা হত, তবে এর অনুমোদন ছিল।
  • উভয় রব্বী শাম্মা ও রব্বী হিল্লেল মনে করতেন যে, বেশ কিছু বছর পরেও সন্তান জন্মগ্রহণ না করলে অর্থাৎ বন্ধা বা নিঃসন্তান হলে, তবে বিবাহবিচ্ছেদ অনুমোদিত।
বিবাহবিচ্ছেদের কারণ হিসাবে ‘ব্যভিচার’
  • সব যুগে ব্যভিচার খুব বড় অপরাধ হিসাবে মনে করা হত এবং কঠোরভাবে বিচার করা হত। মোশির আইন-কানুন অনুসারে ব্যভিচার ছিল মৃত্যুদণ্ড যোগ্য অপরাধ। যদিও সম্ভাবনা বেশি যে, এই অপরাধের শাস্তি প্রায়ই বিস্তার করা হত না (যেমন: দায়ূদের ব্যভিচারের ক্ষেত্রে), তাই যত সময় এগিয়ে যায়, ব্যভিচারের শাস্তি তত কম বিস্তার হতে থাকে।
  • আইন-কানুন অনুসারে, কোন অপরাধ প্রমাণিত হতে দু’জন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীর সাক্ষ্য প্রয়োজন। ব্যভিচারের ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় সাক্ষী পাওয়া কঠিন। যীশুর সমসাময়িক যিহূদী দার্শনিক ফিলো (Philo) ব্যাখ্যা করতেন যে, ব্যভিচার প্রমাণ করা কঠিন বলে মোশি সন্দেহজনক ব্যভিচার প্রমাণের ক্ষেত্রে ‘তেতো জল’ বা ‘অভিশাপের জলের’ প্রক্রিয়া আইনে লিপিবদ্ধ করেছিলেন (গণনা ৫)।
  • সম্ভবত, সেই সময় ব্যভিচার খুব বিরল ছিল, তবে ব্যভিচার সম্বন্ধীয় সামান্য সন্দেহকেও খুব গুরুত্বের সাথে দেখা হত। তাই হয়তো, সেই সময় তেতো জলের প্রক্রিয়া বেশ প্রচলিত ছিল। কিন্তু ৭০ খ্রীষ্টাব্দে রোমীয়রা যখন যিরুশালেম শহর ও উপাসনা-ঘর ধ্বংস করে, তখন থেকে প্রক্রিয়ার আক্ষরিক অনুশীলন অনুসরণ করা আর সম্ভব ছিল না।
  • একটি প্রচলিত চিন্তা ছিল যে, অভিযুক্ত নারী দোষী হলে তবে ‘তেতো জলের’ প্রক্রিয়া দ্বারা সে নিজেই মারা যাবে, অর্থাৎ তাকে বিবাহবিচ্ছেদ করার প্রশ্ন আর ওঠে না। তবুও একজন দোষী স্ত্রীকে বিবাহবিচ্ছেদ করার অধিকার স্বামীর ছিল। এক্ষেত্রে স্বামী যৌতুকের অধিকারী হত।
  • যোষেফ ও মরিয়মের বিষয়ে আলোচনা: ‘বিবাহ ঠিক হওয়া এবং বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা’, এর মাঝে যিহূদীদের কাছে বেশি পার্থক্য ছিল না। অর্থাৎ, মরিয়মের গর্ভাবস্থা বিবাহের আগে বা পরে উভয় সময়েই ব্যভিচার হিসাবে দেখা হত। যোষেফ মরিয়মকে লজ্জায় ফেলতে চান না, কিন্তু তিনি একজন অবিশ্বস্ত মহিলাকে বিবাহ করতেও ইচ্ছুক নন। তিনি হিল্লেল ধরণের বিচ্ছেদ (‘যে কোন কারণে বিচ্ছেদ’) দ্বারা তাকে ছেড়ে দিতে পরিকল্পনা করেন। সেই সময় গর্ভবতী অবিবাহিত মেয়ের ক্ষেত্রে তেতো জলের প্রক্রিয়া ব্যবহার করা হত না, কারণ সবার চোখে তার দোষ ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। যোষেফ যখন ঈশ্বরের নির্দেশ অনুসারে মরিয়মকে তারপরেও বিয়ে করেন, সেই সময় সমাজ তাকে নিশ্চয় মূর্খ বলেছিল।
  • যদি কোনো পুরুষ স্ত্রী ছাড়াও অন্য নারীর সাথে যৌন সম্পর্ক রাখত তবে তা ব্যভিচার হিসাবে ধরা হত না বরং তা বহুবিবাহ হিসাবে দেখা হত। তার স্ত্রী একারণে বিবাহবিচ্ছেদ চাইলে তা বিবাহবিচ্ছেদের যথেষ্ট কারণ হিসাবে ধরা হত না। কিন্তু যদি একজন স্ত্রী দ্বিতীয় সম্পর্ক স্থাপন করত, তবে তা স্বামীর বিরুদ্ধে অপরাধ হিসাবে ধরা হত।
  • যদিও পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় যে, স্বামী ও স্ত্রীর সম অধিকার ছিল না, তবুও একজন নারীকে জোর করে বিবাহে রাজি করানো যেত না। বিবাহ তখনও ছিল স্বেচ্ছায় শপথ গ্রহণের একটি অধিকার।
  • বিবাহিত একজন স্ত্রী ব্যভিচার করেছে কিনা তার প্রমাণ সন্দেহ হিসাবে ধরা হত: খোলা চুল, শরীর ঢেকে না রাখা ইত্যাদি। এক্ষেত্রে ব্যভিচার বলে স্ত্রীকে বিবাহবিচ্ছেদ করার অধিকার স্বামীর ছিল এবং বিবাহবিচ্ছেদের সময় স্ত্রীর আনা যৌতুক স্বামীর কাছে থেকে যেত। কিন্তু স্ত্রী নির্দোষ হলে, তেতো জলের প্রক্রিয়া এক্ষেত্রে স্ত্রীকে দোষমুক্ত হিসাবে প্রমাণ করতে পারত।
যাত্রা ২১:১০-১১ বিবাহবিচ্ছেদের জন্য গ্রহণযোগ্য কারণ

“সেই মনিব সেই দাসীকে বিয়ে করবার পরেও যদি অন্য কাউকে বিয়ে করে তবুও সে তার খোরাক-পোশাক দিতে বাধ্য থাকবে এবং দেহের দিক থেকে তার যা পাওনা তা-ও তাকে দিতে হবে। ১১ সে যদি এই সব কর্তব্য না করে তবে কোন টাকা না নিয়েই তাকে চলে যেতে দিতে হবে।”
কেরী: “যদি সে অন্য স্ত্রীর সহিত তাহার বিবাহ দেয়, তবে উহার অন্নের ও বস্ত্রের এবং সহবাসের বিষয়ে ত্রুটি করিতে পারিবে না।”

  • যিহূদী রব্বীরা এই পদটি ব্যাখ্যা করে বলতেন যে, একজন দাসী-স্ত্রীর কোনো অধিকার থাকলে, তবে স্বাধীন স্ত্রীর নিশ্চয়ই সেই অধিকার ছিল। তাই পদটি সাধারণভাবে স্ত্রীর অধিকার হিসাবে ধরা হত, অর্থাৎ স্ত্রীকে তা না দিলে তা বিবাহবিচ্ছেদের গ্রহণযোগ্য কারণ হিসাবে দাঁড়াত। নিচে অধিকারগুলো ব্যাখ্যা করা হল:
    • ১ (she’arah) “দেহের দিক যা পাওনা”, “অন্নের” ইংরেজিতে ‘food’, আক্ষরিক অর্থে ‘মাংস’, সাধারণত এর অনুবাদ করা হয়: ‘খাবার’, ‘ভাল খাবার’ (কারণ হয়তো মাংস রীতিমত খাওয়া হত না), ‘শারীরিক সুঅবস্থা’, এমন কি ‘যৌনসন্তুষ্টি’। সবচেয়ে প্রচলিত অনুবাদ: ‘খাবার’ বা ‘যোগান’।
    • 2 (kesutha) “খোরাক-পোশাক”, “বস্ত্র”, ইংরেজিতে ‘clothing, accommodation’, covering’, আছন্ন করার মত বা ঢেকে দেওয়ার মত প্রয়োজনীয় কাপড়, যোগান ও বাসস্থান।
    • 3 (onathah) “সহবাসের বিষয়ে” এই শব্দের অনুবাদ কঠিন। ইংরেজিতে ‘her abode, her right of parenthood, her emotional right, ointment, মানে ‘সহবাস, মা হওয়ার অধিকার, যৌন সম্পর্ক, মলম’। প্রচলিত অনুবাদ: “দেহের দিক যা পাওনা”, স্বামী-স্ত্রীর যৌন সম্পর্ক।
  • নতুন নিয়মের সময়ে এর সর্বসম্মত অনুবাদ ছিল “খাবার, পোশাক ও স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের অধিকার”, যদিও এই ৩টি শব্দের অনুবাদ নিয়ে বিভিন্ন মতামত আছে।
  • এর অর্থ কি?
    • স্বামী যদি দাসী-স্ত্রীকে এই ৩টি বিষয়ের ক্ষেত্রে যোগান না দিত, অর্থাৎ বিবাহের দায়িত্ব অবহেলা করত, তবে দাসী-স্ত্রীর মুক্ত হিসাবে চলে যাওয়ার অধিকার ছিল। এক্ষেত্রে সেই দাসী-স্ত্রী বিবাহ, দাসত্ব এবং ঋণ থেকে মুক্ত হত (স্বামীর কাছে পূর্বের কোন ঋণ থাকলে)।
    • স্বামী যদি স্বাধীন-স্ত্রীর ক্ষেত্রে এই ৩টি দায়িত্বের বিষয়ে অবহেলা করে, তবে স্ত্রীর বিবাহবিচ্ছেদ দাবি করার অধিকার রয়েছে এবং বিচ্ছেদপ্রাপ্ত নারীর যৌতুক ফিরে পাওয়ার অধিকার ছিল।
  • এই ৩টি অধিকারের পাশাপাশি ব্যভিচারকে বিবাহবিচ্ছেদ দাবি করার চতুর্থ গ্রহণযোগ্য কারণ হিসাবে ধরা হত।
  • রব্বী শাম্মা ও রব্বী হিল্লেল উভয়েই বিবাহবিচ্ছেদের জন্য এই ৪টি কারণকে গ্রহণযোগ্য হিসাবে একমত পোষণ করেন। কিন্তু কত সময় পর্যন্ত স্ত্রীর সাথে সহবাস প্রত্যাখ্যান করা ‘দায়িত্ব ভাঙ্গা বা অবহেলা’ হিসাবে ধরা উচিত, এই বিষয়ের তাদের মধ্যে দ্বিমত ছিল।
  • পরবর্তী রব্বীরা এটিকে ‘বস্তুগত অবহেলা’ (material neglect) এবং ‘আবেগীয় বা মানসিক অবহেলা’ (emotional neglect), এই ২ ভাগে ভাগ করেন। বস্তুগত অবহেলা সাধারণত বিবাহবিচ্ছেদের কারণ হিসাবে ধরা হত। কিন্তু আবেগীয় অবহেলা সমঝোতার প্রচেষ্টায় অর্থাৎ সমাধান করার প্রচেষ্টায় রাখা হত, এ প্রক্রিয়ায় জরিমানা প্রদানের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদ প্রতিরোধের চেষ্টা করা হত।
  • বস্তুগত অবহেলা: রব্বীরা এটিকে খাদ্য ও পোশাকের অনবরত সরবরাহ বা যোগান হিসাবে ব্যাখ্যা করতেন। স্বামীর এগুলো সরবরাহ করার দায়িত্ব ছিল – এবং স্ত্রীর দায়িত্ব ছিল খাবার প্রস্তুত করা ও মসীনা বা মাল থেকে পোশাক বানানো। রব্বীরা এই বিষয়ে নির্দিষ্ট বস্তু, পরিমাণ ও কার্যক্রমের বিবরণ তৈরি করেছিলেন।
  • রব্বীরা আরো বলতেন যে, যিহূদা ও গালীলের বাইরে বসবাসকালীন অবস্থায়, স্ত্রী যিহূদী হলে তবে তাকে জোর করে যিহূদা বা যিরুশালেমে নিয়ে যাওয়ার অধিকার স্বামীর ছিল। অন্যথায়, যিহূদা ও গালীলে বসবাসকালীন অবস্থায় স্ত্রী যিহূদী হলে, তবে যিহূদী স্ত্রীকে জোর করে বাইরের এলাকায় বসবাস করতে বাধ্য করানোর অধিকার স্বামী নেই। এভাবে জন্মগত পরিবার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে বসবাসের নিয়ম ছিল।
  • আবেগীয় অবহেলা: সহবাসের দায়িত্ব পুরুষদের ক্ষেত্রে পেশা অনুসারে ঠিক করা হত, যেমন: ধনী লোকদের ক্ষেত্রে একদিনও স্ত্রী থেকে আলাদা থাকার অনুমতি ছিল না। কর্মীদের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ২ দিন এবং শ্রমিকদের ক্ষেত্রে ৭ থেকে ৩০ দিন আলাদা থাকার অনুমতি ছিল। এর চেয়ে বেশি দিন আলাদা থাকা বিবাহবিচ্ছেদের গ্রহণযোগ্য কারণ হিসাবে দাঁড়াত। স্ত্রীর ক্ষেত্রে কোন নির্দিষ্ট নিয়ম ছিল না।
  • যিহূদী আদালত বিবাহবিচ্ছেদ করতে সহজে অনুমতি দিত না। তার চেয়ে তারা বিভিন্ন ধরণের জরিমানা বিস্তার করে বিবাহ রক্ষা করতে চেষ্টা করত: বিদ্রোহী স্ত্রীর ক্ষেত্রে দেনমোহরের পরিমাণ কমানো হত এবং বিদ্রোহী স্বামীর ক্ষেত্রে দেনমোহরের পরিমাণ বাড়ানো হত।
  • একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল: রব্বীদের লেখায় ‘দাম্পত্য অধিকার’ জোর করে আদায়ের বিষয়ে কোথাও উল্লেখ নেই। তা দায়িত্ব হিসাবে ঘোষণা করা হত, কিন্তু জোর করে দাবি করার অনুমোদন ছিল না। বৈবাহিক ধর্ষণ যিহূদী রব্বীদের লেখায় অনেক আগে থেকে নিষিদ্ধ হিসাবে ঘোষনা করা হয়।
  • আবেগীয় বা মানসিক অবহেলার মধ্যে সম্ভবত আরও অনেক কিছু অন্তর্ভুক্ত ছিল: নির্যাতন, মারধর, হিংস্রতা অথবা অন্যদের সামনে লজ্জা দান বা অপমান করা – এগুলো রব্বীদের লেখাগুলোতে বিবাহবিচ্ছেদ দাবি করার গ্রহণযোগ্য কারণ হিসাবে ঘোষণা করা হত (তবে তা কোন সময় থেকে এর নির্দিষ্ট তারিখ পাওয়া যায় না)।
  • স্ত্রীর বিরুদ্ধে স্বামীর এবং স্বামীর বিরুদ্ধে স্ত্রীর নিষ্ঠুরতার সীমানা যিহূদী রব্বীরা নির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করে উল্লেখ করেন। দাম্পত্য জীবনে নিষ্ঠুরতা থাকলে তবে আদালত বিবাহবিচ্ছেদের অনুমোদন দিত, কিন্তু ‘আবেগীয় বা মানসিক অবহেলার’ ক্ষেত্রে জরিমানা দ্বারা বিবাহকে রক্ষা করতে চেষ্টা করা হত।
  • যিহূদী মিশ্না (mishna) ‘আবেগীয় বা মানসিক অবহেলা’র ক্ষেত্রে বলে যে, যদি এক মাস ধরে ‘আবেগীয় বা মানসিক অবহেলা’ করা হয় তবে স্ত্রী বিবাহবিচ্ছেদ দাবি করতে পারত। এক্ষেত্রে স্ত্রী যৌতুক ফিরে পেত, অর্থাৎ এই বিবাহবিচ্ছেদের দোষ স্ত্রীর নয় বরং স্বামীর দোষ হিসাবে ধরা হত।
  • যিহিষ্কেল ১৬:১৬-১৯ পদে ঈশ্বর বলেন যে, তিনি ইস্রায়েলকে খাবার, পোশাক এবং আরও অনেক কিছুর যোগান দিয়েছিলেন কিন্তু ইস্রায়েল ব্যভিচার করেছে এবং বেশ্যার মত আচরণ করেছে।
দ্বিতীয় বিবরণ ২৪:১ -৪ ‘যে কোন কারণে’ বিবাহবিচ্ছেদ’ (any ground divorce)

“বিয়ে করবার পরে যদি কেউ স্ত্রীর মধ্যে কোন দোষ দেখে তার উপর অসন্তুষ্ট হয় আর ত্যাগপত্র লিখে তার হাতে দিয়ে তাকে বাড়ী থেকে বিদায় করে দেয়, 2আর স্ত্রীলোকটি তার বাড়ী থেকে চলে গিয়ে যদি আর কাউকে বিয়ে করে এবং তার দ্বিতীয় স্বামীও যদি পরে তাকে অপছন্দ করে তার প্রতি তা-ই করে, কিম্বা সেই স্বামী যদি মারা যায়, 4তবে তার প্রথম স্বামী, যে তাকে বিদায় করে দিয়েছিল সে তাকে আর বিয়ে করতে পারবে না, কারণ সে অশুচি হয়ে গেছে। এই রকমের বিয়ে সদাপ্রভু ঘৃণা করেন। সম্পত্তি হিসাবে যে দেশটা তোমাদের ঈশ্বর সদাপ্রভু তোমাদের দিতে যাচ্ছেন তোমরা এইভাবে তার উপর পাপ ডেকে আনবে না।”
কেরী: “কোন পুরুষ কোন স্ত্রীকে গ্রহণ করিয়া বিবাহ করিবার পর যদি তাহাতে কোন প্রকার অনুপযুক্ত ব্যবহার দেখিতে পায়, আর সেই জন্য সেই স্ত্রী তাহার দৃষ্টিতে প্রীতিপাত্র না হয়, তবে …”

  • দ্বিতীয় বিবরণ ২৪:১ পদে উল্লিখিত বাক্যের সাধারণ বাংলা অনুবাদ “কোন দোষ দেখে স্ত্রীর উপর অসন্তুষ্ট হয়”, কেরী অনুবাদ “কোন প্রকার অনুপযুক্ত ব্যবহার দেখিতে পায়”, ইংরেজী অনুবাদ “a matter of indecency” এর প্রকৃত অর্থ কি? রব্বী শাম্মা ও রব্বী হিল্লেল এই বিষয়ে একমত ছিলেন না।
  • রব্বী হিল্লেলের ব্যাখ্যা অনুসারে, বিবাহবিচ্ছেদের ৪টি গ্রহণযোগ্য কারণ ছাড়াও অন্য ‘যে কোন কারণে’ বিবাহবিচ্ছেদ হতে পারে। তিনি বলতেন যে, খারাপ রান্না থেকে শুরু করে ‘যে কোন কিছু’ অসন্তুষ্টির বিষয় হয়ে দাঁড়াতে পারে।
  • অপরদিকে, রব্বী শাম্মা ব্যাখ্যা করতেন যে, যাত্রা ২১:১০-১১ পদে অন্তর্ভুক্ত ৩টি কারণ এবং ব্যভিচার (অর্থাৎ মোট ৪টি কারণ)-এ বিবাহবিচ্ছেদ গ্রহণযোগ্য। রব্বী শাম্মার ব্যাখ্যা হিল্লেলের ব্যাখ্যার চেয়ে প্রচলিত ছিল।
  • হিল্লেলীয় আদালতে বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে কোনো প্রমাণের প্রয়োজন ছিল না। হিল্লেলীয় বিবাহবিচ্ছেদ দ্রুত জনপ্রিয় ও অতি সাধারণ হয়ে উঠেছিল। ‘মুহূর্তের মধ্যে ও আবেগে’ বিবাহবিচ্ছেদ যেন না হয়, এ কারণে পরবর্তীতে হিল্লেলীয় রব্বীরা দ্বিতীয় ২৪:১-৪ পদ অনুসারে বেশ জটিল একটি প্রক্রিয়া দাবি করতে লাগল (যেমন: বিচ্ছেদ-পত্র বা তালাক-নামা লেখা, হাতে পৌঁছানো এবং বাসা থেকে স্ত্রী তাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে নিয়ম এবং জরিমানা পদ্ধতি)।
  • তারপরেও হিল্লেলীয় বিবাহবিচ্ছেদ দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, কারণ সাধারণ মানুষের পক্ষে আদালতের সাহায্যে তদন্ত করে দোষ প্রমাণ করা ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং কষ্টের, এমনকি তা লজ্জারও বিষয়।
  • যোষেফ মরিয়মকে লজ্জায় ফেলতে চান না বলে তিনি ঠিক এরকম একটি হিল্লেলীয় বিবাহবিচ্ছেদের পরিকল্পনা করেন এবং সুসমাচার লেখক মথি এর জন্য তাকে “সৎ লোক” বলেন (মথি ১:১৯)।
  • একটি হিল্লেলীয় বিবাহবিচ্ছেদ বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে স্বামীকে ত্যাগপত্র লিখতে হত এবং বিচ্ছেদপ্রাপ্ত স্ত্রীকে যৌতুক ফেরত দিতে হত, যেন তা একটি বৈধ বিবাহবিচ্ছেদ হিসাবে স্বীকৃতি পায়। যদি যৌতুক নিয়ে দ্বন্দ্ব হত, শুধুমাত্র তখনই আদালতে যাওয়ার প্রয়োজন হত। দাম্পত্য জীবনে স্ত্রীর উপার্জন স্বামীর আয় হিসাবে বিবেচিত হত।
  • মেয়েরা প্রাপ্ত বয়সে পৌঁছানোর আগে, অর্থাৎ সাড়ে ১২ বছর হওয়ার আগেই প্রায় মেয়েদের বিয়ে ঠিক করা হত, তাই তারা বিয়ে অগ্রাহ্য করতে পারত না। তবে প্রাপ্ত বয়সে পৌঁছিয়ে মেয়েরা তাদের বিয়ের বিষয়ে অস্বীকৃতি জানাতে সমর্থ্য হত। একারণে বিধবা ও বিবাহবিচ্ছেদ-প্রাপ্ত নারীদের তুলনায় অল্প বয়সী মেয়েদের অবস্থান বেশ ভিন্ন ছিল।
  • আইনগতভাবে ত্যাগপত্রের অর্থ হল এই যে, বিবাহবিচ্ছেদ-প্রাপ্ত নারী বা পুরুষের পুনর্বিবাহ করার অধিকার আছে। একারণে ত্যাগপত্রের প্রয়োজন রয়েছে। পৌল বিধবাদের ক্ষেত্রে বলেন যে, “সে যাকে ইচ্ছা তাকে বিয়ে করতে পারে” (১ করি ৭:৩৯)। এখানে পৌল ত্যাগপত্রে ব্যবহৃত শব্দ ব্যবহার করেন।
  • শাস্ত্র অনুসারে, একজন নিঃসন্তান বিধবার তার মৃত স্বামীর ভাইকে বিবাহ করার অধিকার রয়েছে, এমন কি তাকে বিয়ে করার নিয়ম ছিল (দ্বিতীয় বিবরণ ২৫:৫-৯)। ইনস্টন-ব্রূয়ার বলেন: এক্ষেত্রে মৃত স্বামীর ভাই বিধবাকে বিয়ে করতে প্রত্যাখ্যান করলে, তবে তাকে সবার সামনে প্রকাশ্যে লজ্জাদায়ক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিবাহ করতে বাধ্য করানো হত।
  • যিহূদীদের চোখে একজন বিধবাকে বিবাহ করা ছিল নৈতিক ও গ্রহণযোগ্যজনক একটি বিষয়। একইভাবে আইনগতভাবে একজন বিবাহবিচ্ছেদ-প্রাপ্ত নারীকে বিবাহ করা ছিল নৈতিক ও গ্রহণযোগ্যজনক বিষয়, এক্ষেত্রে মাত্র ব্যতিক্রম হল যে, বিবাহবিচ্ছেদের কারণ যদি ব্যভিচার হত। এই ধরণের দ্বিতীয় বিয়েতে বরের দেন-মোহরের পরিমাণ (bride-price) ছিল মাত্র অর্ধেক। বিধবা ও বিবাহবিচ্ছেদ-প্রাপ্ত নারীদের প্রায়ই ২য় স্ত্রী হিসাবে বিয়ে করা হত।
  • যৌতুকের নূন্যতম পরিমাণ ছিল একজন দিনমজুরের প্রায় ৮ মাসের মজুরীর সমান। এর অর্থ এই যে, একজন বিবাহবিচ্ছেদ-প্রাপ্ত নারী এই টাকায় বাকী জীবন কাটাতে পারত না। ফলে তার পুনর্বিবাহের জন্য চেষ্টা করতে হত। যদিও স্বচ্ছল বা ধনী বিবাহবিচ্ছেদ-প্রাপ্ত নারীদের এমন চাপ হত না।
  • যিহূদী রব্বীদের লেখাগুলোতে নারীদের প্রায় পুরুষদের মত অধিকার ছিল, শুধুমাত্র সন্তান নেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের অধিকার কম ছিল।
  • যিহূদী রব্বীদের লেখায় এবং নতুন নিয়মে সন্তান জন্মদানের বয়সের বিধবা ও বিবাহবিচ্ছেদ-প্রাপ্ত নারীদের পুনর্বিবাহ করতে উৎসাহিত করা হত, যদিও তাদেরকে পুনর্বিবাহে বাধ্য করা হত না (১ তীমথিয় ৫:১৪)।
  • আইনগতভাবে বিবাহবিচ্ছেদ না হওয়া নারী যদি পুনর্বিবাহ করত, তবে তা ব্যভিচার হিসাবে ধরা হত।

বিবাহবিচ্ছেদ ও পুনরায় বিবাহ করার বিষয়ে যীশুর মন্তব্য

যীশুর কাছে ফরীশীদের প্রশ্ন মথি ১৯:৩-১০, মার্ক ১০:১-১২

‘”তখন কয়েকজন ফরীশী যীশুকে পরীক্ষা করবার জন্য তাঁর কাছে এসে বললেন, “মোশির আইন-কানুন মতে যে কোন কারণে স্ত্রীকে ছেড়ে দেওয়া কি কারও পক্ষে উচিত?” ৪ উত্তরে যীশু বললেন, “আপনারা কি পড়েন নি, সৃষ্টিকর্তা প্রথমে তাঁদের পুরুষ ও স্ত্রীলোক করে সৃষ্টি করেছিলেন আর বলেছিলেন, ৫ ‘এইজন্যই মানুষ মা-বাবাকে ছেড়ে তার স্ত্রীর সংগে এক হয়ে থাকবে আর তারা দু’জন একদেহ হবে’? ৬ এইজন্য তারা আর দুই নয়, কিন্তু একদেহ। তাই ঈশ্বর যা একসংগে যোগ করেছেন মানুষ তা আলাদা না করুক।’ “

  • যীশুকে পরীক্ষা করার জন্য ফরীশীরা একটি বিতর্কের প্রশ্ন করে। আসলে তারা রব্বী হিল্লেল ও রব্বী শাম্মার অসম্মতির বিষয় নিয়ে আসে: যে কোন কারণে কি বিবাহবিচ্ছেদ করা অনুমোদিত? এই প্রশ্নের উত্তরে যীশু যদি “হ্যাঁ” বলেন, তবে শাম্মার ব্যাখ্যা সমর্থনকারী ফরীশীরা অখুশি হবে। অথবা, যীশু যদি “না” বলেন, তবে হিল্লেলীয় ব্যাখ্যা সমর্থনকারী ফরীশীরা অখুশি হবে।
  • মার্ক সুসমাচারে “যে কোন কারণে’”এই উক্তিটি উল্লেখ করা নেই, লেখক মাত্র বলেন যে, “মোশির আইন-কানুন মতে স্ত্রীকে ছেড়ে দেওয়া কি কারও পক্ষে উচিত?”। সব ফরীশীরা একমত ছিলেন যে, ‘ব্যভিচার এবং যাত্রা ২১:১০-১১ পদের ৩টি কারণে’ অর্থাৎ সর্বমোট ৪টি কারণে বিবাহবিচ্ছেদ করার অনুমোদন রয়েছে। তারা মাত্র “যে কোন কারণে’” (দ্বিতীয় বিবরণ ২৪:১) পদের ব্যাখ্যা নিয়ে দ্বিমত। সম্ভবত, মার্ক লিখিত সুসমাচারে লেখক মার্ক মনে করেন যে, প্রশ্নটি সবার কাছে স্পষ্টতই, তাই তিনি “যে কোন কারণে’” এই কথাটি উল্লেখ করেন না। তবে মথি লিখিত সুসমাচারে লেখক মথি প্রশ্নটি পরিষ্কার হওয়ার জন্য সঠিক কথাগুলো উল্লেখ করেন, কিন্তু ঘটনাটি একই।
  • মার্ক লিখিত সুসমাচার অনুসারে, ফরীশীদের প্রশ্ন যদি হত “যে কোন কারণে’” বিবাহবিচ্ছেদ করা কি বৈধ? এক্ষেত্রে যীশুর উত্তর হত: ‘হ্যাঁ, আইন-কানুনে কিছু নির্দিষ্ট কারণে এর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে’।
  • প্রথমদিকে বোধ হয় যে, যীশু তাদের প্রশ্নের উত্তর দেন না। এর চেয়ে তিনি তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, বিবাহের বিষয়ে ঈশ্বরের উদ্দেশ্য প্রথমে ছিল ‘একবিবাহে সমর্পিত এবং আজীবন-ব্যাপী একটি সম্পর্ক’। এতে তিনি তাদের একেবারে ‘শুরুতে’ নিয়ে যান, এবং আদি ১:২৭আদি ২:২৪ পদ উদ্ধৃতি করেন। ঈশ্বর যেভাবে বিবাহ ও বিবাহের উদ্দেশ্য স্থাপন করেছেন তিনি তা তাদেরকে বলেন। তিনি বলেন না যে, ‘সেই সময় বা আদিতে তা ঐরকম ছিল, কিন্তু বর্তমান সময়ে এটি ভিন্ন হবে!’ বরং তিনি বলেন ‘এটাই হল ঈশ্বরের ইচ্ছা ও বিবাহের সর্বোচ্চ মানদন্ড’।
  • যীশুর সমসাময়িক রব্বীরা যারা একবিবাহের পক্ষে কথা বলতেন, তারা আদি ১:২৭ এবং আদি ৭:৯-১০ পদের (“জোড়ায় জোড়ায়”) শব্দটি ব্যবহার করে তাদের শিক্ষা সমর্থন করতেন। তাই খুব সম্ভবত, যীশুর শ্রোতাদের মনে এই চিন্তা থাকবে।
  • যীশু উত্তরে বলেন “মানুষ তা আলাদা না করুক”“আলাদা” শব্দের অন্যতম অর্থ হল “বিচ্ছেদ”। ছবিটি এই: বিবাহের দিনে বর ও কনে উভয়ে পরস্পরের সাথে প্রতিজ্ঞা করে নিজেদের একটি বন্ধনে আবদ্ধ করে এবং ঈশ্বর তাদেরকে “একসঙ্গে যোগ” করেন, আশীর্বাদ করেন ও বিবাহের শপথের সাক্ষী হিসাবে দাঁড়ান। মালাখি ঠিক এভাবে ঈশ্বরকে বিবাহের সাক্ষী হিসাবে দেখান: “সদাপ্রভু তোমাদের প্রত্যেক লোকের ও তার যৌবনকালের স্ত্রীর বিয়ের সাক্ষী হয়েছিলেন” (মালাখি ২:১৪)।
  • “মানুষ আলাদা না করুক” মানে না ‘আলাদা করা অসম্ভব’ বরং এটি স্বামী-স্ত্রীর কাছে একটি আদেশ, যেন তারা বিবাহের সম্পর্ক না ভাঙ্গে। যীশু বোঝাতে চেয়েছেন যে, বিবাহের শপথ ভাঙ্গাই ‘পাপ’।
  • যীশু তার নিজের উত্তর উপযুক্ত মনে করেন কিন্তু উভয় হিল্লেল ও শাম্মার ব্যাখ্যা সমর্থনকারী ফরীশীরা সন্তুষ্ট হয় না। ‘তখন ফরীশীরা তাঁকে বললেন, “তাহলে মোশি কেন ত্যাগপত্র দিয়ে স্ত্রীকে ছেড়ে দিতে আদেশ করেছেন?’ যীশু তাদের বললেন, ‘আপনাদের মন কঠিন বলেই স্ত্রীকে ছেড়ে দিতে মোশি আপনাদের অনুমতি দিয়েছেন। কিন্তু প্রথম থেকে এই রকম ছিল না।”
  • ফরীশীরা এখানে দ্বিতীয় বিবরণ ২৪:১ পদ উদ্ধৃতি করে প্রমাণ করতে চায় যে, মোশি বিবাহবিচ্ছেদ অনুমোদিত করেছেন – এবং মাত্র একটি শর্তে যে, ত্যাগপত্র দিতে হবে। এই ‘সহজ বিবাহবিচ্ছেদ’ পদ্ধতি ছিল মাত্র পুরুষদের জন্য, এই স্বাধীনতা তারা নারীদের জন্য উন্মুক্ত করতে রাজী ছিল না। তারা নিজেদের স্বার্থপরতাকে ন্যায্যতা হিসাবে দাঁড় করাতে আইনকে ব্যবহার করতে চেষ্টা করত।
  • এখন প্রশ্ন ওঠে: যদি ঈশ্বর বিবাহবিচ্ছেদ ঘৃণা করেন, তবে কেন তিনি ত্যাগপত্র সম্বন্ধীয় এই আইন দিলেন?
  • উত্তরে বলা যায় যে, কারণ মানুষ পাপী, মানুষ মন্দকে ভালবাসে, স্বেচ্ছায় অন্যায় করে এবং একজনের মন্দ আচরণের ফলে অন্যজন ক্ষতির শিকার হয়। ঈশ্বর কখনই এমন চান নি, কিন্তু মানুষ ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আচরণ করতে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এটাই হল বাস্তবতা।
  • ত্যাগপত্র সম্বন্ধীয় এই আইন ‘ঈশ্বরের হৃদয়ের সর্বোচ্চ ইচ্ছার প্রকাশ’, এমন নয়। বরং আইনটি হল ‘পাপের ক্ষতি কমানোর একটি আইন’, অর্থাৎ মন্দ সিদ্ধান্তের ক্ষতি কমানোর আইন, অর্থাৎ সর্বনিম্ন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার একটি প্রচেষ্টা।
  • মূলত, এই আইনের অর্থ হল: বৈবাহিক সম্পর্ক যদি একজন রক্ষা করতে কোনভাবেই রাজি না থাকে, তবে কমপক্ষে আইনগতভাবে বিবাহবিচ্ছেদ করুক, যাতে ত্যাগপত্র পেয়ে বিবাহবিচ্ছেদ-প্রাপ্ত স্ত্রী পুনরায় বিয়ে করতে পারে। এক্ষেত্রে আইনের অর্থ হল: অন্যায়ের মধ্যে ‘সর্বনিম্ন ন্যায্যতা নিশ্চিত করা’।
  • পুরুষেরা ত্যাগপত্র হাতে পাওয়ার উপর নির্ভরশীল নয়, কারণ তাদের ক্ষেত্রে বহুবিবাহ অনুমোদিত ছিল। কিন্তু ত্যাগপত্র ছাড়া নারীদের পুনরায় বিবাহ করার অনুমতি ছিল না, কারণ নারীদের ক্ষেত্রে বহুবিবাহ অনুমোদিত ছিল না। তাই আইনগতভাবে ত্যাগপত্র না দেওয়ার অর্থ হল নারীর বিরুদ্ধে অন্যায় করা, তাকে অবহেলা করা এবং তার ভবিষ্যৎ জীবনও নষ্ট করা।
  • “’আপনাদের মন কঠিন বলেই” যীশু কেন তাদের এভাবে ধমক দেন? কারণ তারা আইনের ভুল ব্যবহার করে তা স্বার্থপরভাবে, অর্থাৎ নিজেদের সুবিধার জন্য অজুহাত হিসাবে ব্যবহার করতে চায়। আইনের মধ্য দিয়ে তারা নিজেদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে চায়, কিন্তু অন্যদের স্বাধীনতা ও অধিকার তারা অগ্রাহ্য করে।
  • ব্যভিচার হওয়ার পরে যে বিবাহবিচ্ছেদ আবশ্যক, এমন নয়। যদি ব্যভিচারী ক্ষমা চাওয়া ও স্বেচ্ছায় নিজেকে দায়বদ্ধ রাখা দ্বারা এবং বিবাহিত সঙ্গী ক্ষমা ও দ্বিতীয় সুযোগ দান করা দ্বারা যদি কোন মিমাংসা বা পুনর্মিলনে আসতে রাজি হয়, সেক্ষেত্রে তা বিবাহবিচ্ছেদের চেয়ে অনেক ভাল। যীশু বিবাহবিচ্ছেদ নিষেধ করেন না, কিন্তু তিনি এটি নিরুৎসাহিত করেন। তিনি তার অনুসরণকারীদের বিবাহবিচ্ছেদ প্রতিরোধ করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করতে বলেন।
  • যদি আমরা বলি: বিবাহবিচ্ছেদ বাইবেলে সম্পূর্ণভাবে নিষেধ, তবে (অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও) তা অন্য ক্ষেত্রে নতুন অন্যায় সৃষ্টি হয়। বৈবাহিক সম্পর্ক রক্ষা করা উচিত, তা ঠিক। কিন্তু মানুষের জীবন রক্ষা করা উচিত, তাও ঠিক। বিভিন্ন মূল্যবোধ একসাথে ধরে রাখতে হবে (বিবাহ মূল্যবান, নিরাপত্তায় বাস করা মূল্যবান, নারীর জীবন মূলবান)। মূল্যবোধের মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করতে হবে। প্রত্যেক বিষয়ের সঠিক মূল্য এবং উপযুক্ত সীমানাও রয়েছে।
  • প্রকৃতপক্ষে, ফরীশীরা দ্বিতীয় বিবরণ ২৪:১ পদ নিয়ে আসে। যীশু বলেন যে, বৈবাহিক জীবন হওয়ার কথা আজীবনের জন্য। ফরীশীরা দাবি করে যে, এই পদ অনুসারে বিবাহবিচ্ছেদ করার অনুমোদন রয়েছে, এমন কি কিছু ক্ষেত্রে (যেমন: ব্যভিচার ঘটলে) তা আবশ্যক। তাই তাদের উপসংহার হল ‘বিবাহ আজীবনের বিষয় নাও হতে পারে’।
  • যীশু বলেন যে, মোশির আইন-কানুনে কোথাও বিবাহবিচ্ছেদের আদেশ নেই, অনুমোদনও নেই, তবুও বিবাহবিচ্ছেদের অনুমতি আছে। এই কথার অর্থ এই্ যে, এমন কি ব্যভিচার ঘটলেও বিবাহবিচ্ছেদ আবশ্যক নয়।
  • কিন্তু যদি ব্যভিচার বার বার ঘটে এবং চেতনা, অনুতাপ বা পরিবর্তন দেখা না যায়, সেক্ষেত্রে বিবাহবিচ্ছেদ করা প্রয়োজন হতে পারে। যীশুর মন্তব্য “আপনাদের মন কঠিন বলেই” ঠিক এই ধরণের অবস্থা বর্ণনা করে। মানুষের একগুঁয়েমি মনোভাব ও কঠিন হৃদয়ের কারণে বিবাহবিচ্ছেদ অনুুমোদিত হয়েছে। একগুঁয়েমিতা শব্দের উল্লেখ যিরমিয়ের বিভিন্ন পদ স্মরণ করিয়ে দেন (যিরমিয় ৩:১, ৩:৩, ৩:১৩, ৩:১৭, ৩:২০), যেখানে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে ইস্রায়েলের একগুঁয়েমি মনোভাব, অর্থাৎ হৃদয়ের কঠিন অবস্থা তুলনা করা হয় সুন্নত না করানো হৃদয়ের সাথে। এই রূপক যিরমিয় পুস্তকে ইস্রায়েলের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে, যা স্বামী ঈশ্বরের বিরুদ্ধে দেবতাপূজা, অর্থাৎ ব্যভিচার করতে থাকে এবং কোন মতে মন ফিরাতে রাজি না।
  • ব্যভিচারীকে ক্ষমা করতে যীশু উৎসাহিত করেন এবং মাত্র বলেন যে, শুধুমাত্র অনুতাপ ও পরিবর্তন না হলে সেক্ষেত্রে বিবাহবিচ্ছেদ করা প্রয়োজন হতে পারে। যীশু তার শিক্ষাদানে বলেন যে, অনুতপ্ত ব্যক্তিকে অবশ্যই ক্ষমা করতে হবে (লূক ১৭:৩-৪)।
  • যীশুর এই উক্তি (ব্যভিচারীকে ক্ষমা করে গ্রহণ করা) ধার্মিক যিহূদীদের কাছে আচমকানোর মত লাগবে। ব্যভিচার বড় অপরাধ বলে ‘ক্ষমা করা’ লজ্জার বিষয় হিসাবে মনে করা হত। ভাববাদী হোশেয় এবং মরিয়মের স্বামী যোষেফ এই মনোভাবের সম্মুখীন হয়েছিলেন।
  • “যে কোনো কারণে” বিবাহবিচ্ছেদ করা কি অনুমোদিত? যীশু তাদের এই প্রশ্নের উত্তরে বলেন “৯ আমি আপনাদের বলছি, যে কেউ ব্যভিচারের দোষ ছাড়া অন্য কোন কারণে স্ত্রীকে ছেড়ে দিয়ে অন্যকে বিয়ে করে সে ব্যভিচার করে।”
  • মার্ক সুসমাচারে এই উক্তি ফরীশীদের কাছে বলা নয় বরং যীশু তা পরবর্তীতে শিষ্যদের কাছে বলেন।
  • যীশু এখানে কি বলতে চান? প্রকৃতপক্ষে আগের যুগে বা যীশুর সময়ে এমন কোন ঐতিহ্য, নিয়ম-কানুন বা সংস্কৃতি ছিল না যাতে আইনগত বিবাহবিচ্ছেদের পরে পুনর্বিবাহ করা নিষেধ করত।
  • প্রকৃতপক্ষে ব্যভিচার করার অর্থ হল: বিবাহের শপথ ভেঙ্গে অন্য ব্যক্তির সাথে যৌনসম্পর্ক স্থাপন করা। তা চুরির মত দেখা হত, অর্থাৎ তা আর একজনের সম্পত্তি নিয়ে নেওয়ার মত।
  • কেউ কেউ এর ব্যাখ্যা এভাবে করেন: বিবাহবিচ্ছেদ বিশেষ পরিস্থিতিতে বৈধ, কিন্তু পুনরায় বিবাহ করা নিষেধ। প্রকৃতপক্ষে এই ব্যাখ্যাটি আইনের সাথে মিলে না। এরজন্য অধিকাংশ লোক বিষয়টি এভাবে ব্যাখ্যা করে: তা হল আইনগত বিবাহবিচ্ছেদ না করে পুনরায় বিবাহ (বা যৌন সম্পর্ক) সম্বান্ধীয় একটি কথা।
  • যদি আমরা তা এইভাবে ব্যাখ্যা করি তবে তা মথি, লূক ও মার্ক সুসমাচারে উল্লিখিত উক্তি বা শিক্ষার সাথে মিলে:
    • ১) আইনগতভাবে বিবাহবিচ্ছেদ হয় নি এমন নারীকে যদি কোনো পুরুষ বিবাহ করে (লূক ১৬:১৮, মথি ৫:৩২)। যিহূদীদের দৃষ্টিতে বিষয়টি খুব পরিষ্কার ছিল: আগের বিবাহ বা বৈধভাবে বিবাহবিচ্ছেদ না করে, পুনর্বিবাহ করার অর্থ হল ‘ব্যভিচার করা’।
    • ২) যে পুরুষ তার স্ত্রীকে আইনগতভাবে বিবাহবিচ্ছেদ না করে, তবে সে তাকে ব্যভিচারে লিপ্ত করে, অর্থাৎ ব্যভিচারী বানায় (মথি ৫:৩২, মথি ১৯:৯ পদের অন্য অনুবাদ)। একজন পুরুষ তার স্ত্রীকে কিভাবে ব্যভিচারী বানায়? একজন পরিত্যাক্ত নারীকে অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাজনিত কারণে পুনর্বিবাহ করতে হয়, তাই আগের স্বামী যদি স্ত্রীকে আইনগতভাবে বিবাহবিচ্ছেদ না করে, তবে সে সেই নারীকে সংকটে ফেলে। বহুবিবাহের অনুমোদনের কারণে একটি বিবাহবিচ্ছেদ আটকিয়ে গেলে তা স্বামীর জন্য সমস্যা নয়, সে চাইলে অন্য একটি বিবাহ করতে পারে। কিন্তু স্বামী স্ত্রীকে এভাবে আটকিয়ে রাখলে (‘স্ত্রীকে রাখলামও না, বিবাহবিচ্ছেদ করে তাকে স্বাধীনও করলাম না!’), তা নারীর জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। মূল বিষয় এই নয় যে, ‘বিবাহবিচ্ছেদ = ব্যভিচার’। বরং মূল বিষয় হল: আইনগত বিবাহবিচ্ছেদ না হওয়ার কারণে (বিবাহবিচ্ছেদ-পত্র না দিলে) সেই নারী সংকটে পড়ে কারণ পুনরায় বিবাহ করলে তাকে ‘ব্যভিচারী’ হিসাবে গণ্য করা হয়। এতে স্বামী প্রধানত দোষী হয়।
    • ৩) যে পুরুষ আইনগতভাবে বিবাহবিচ্ছেদ না করে পুনর্বিবাহ করে, সে ব্যভিচার করে (মার্ক ১০:১১, মথি ১৯:৯, লূক ১৬:১৮ অনুসারে)। যীশুর এই কথা যিহূদীদের প্রচলিত চিন্তার সাথে একদম মিলে না। আইন-কানুনের প্রচলিত ব্যাখ্যা অনুসারে পুরুষ যদি ‘বিবাহবিচ্ছেদ না করে পুনর্বিবাহ করত’ তবে তা ব্যভিচার হিসাবে ধরা হত না, তা বহুবিবাহ হিসাবে ধরা হত। যীশু যদি একবিবাহ আবশ্যক বলেন তবে বহুবিবাহ বেআইনী ও অবৈধ। স্বামীদের ক্ষেত্রেও যদি বহুবিবাহ অবৈধ, তবে এর অর্থ এই যে, আইনগত বিবাহবিচ্ছেদ না করা পুনর্বিবাহ করা – তা স্বামীদের ক্ষেত্রেও ‘ব্যভিচার’ বলা হয়।
    • লক্ষ্য করুন- মার্ক ১০:১১ পদে যীশু বলেন, “সে তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যভিচার করে”। যিহূদীদের চিন্তা অনুসারে, এই কথার অর্থ নেই। কিন্তু যীশু তা-ই বলেন। যীশু এখানে নারী-পুরুষের পার্থক্য বাতিল করেন: আইনগতভাবে বিবাহবিচ্ছেদ না করে, পুনর্বিবাহ করাই হল ‘ব্যভিচার করা’, উভয় নারীর জন্য (‌আগের মত) এবং পুরুষের জন্য (নতুন আইন!) সমান আইন। দু’জনের জন্য একই আইন। যীশু এখানে বহুবিবাহ ‘মাত্র’ নিরুৎসাহিত করেন, এমন নয়। বরং তিনি বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করেন। তিনি পুরুষ ও নারীর জন্য একই মানদন্ড বসান। নারী যা করলে ‘ব্যভিচার’ হয়, পুরুষও তা করলে ‘ব্যভিচার’ হয়। তবে যীশু যে বিবাহবিচ্ছেদ নিষিদ্ধ করেন, এমন নয়। যা যীশু নিষিদ্ধ করেন (উভয় নারী ও পুরুষের জন্য), তা এই: আইনগত বিবাহবিচ্ছেদ না করে, অর্থাৎ বিবাহবিচ্ছেদ-পত্র ছাড়া পুনরায় বিবাহ করা। যীশু পুরুষদের জন্যও বহুবিবাহ নিষেধ করেন।
    • ৪) যদি স্ত্রী আইনগতভাবে স্বামীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ না করে নতুন বিবাহ করে, তবে সে ব্যভিচার করে (মার্ক ১০:১২)। যিহূদী নিয়মে, পুরুষদের ত্যাগপত্র লেখার অধিকার ছিল বলে, নারীরা সহজে বিবাহবিচ্ছেদ করতে পারত না। আদালতের সাহায্য নিয়ে নারীরা সাধারণত স্বামীদের বিবাহবিচ্ছেদ রাজি করাতে পারত। হয়তো গ্রীক বা রোমীয় আইন অনুসারেস্বামীদেরকে বিবাহবিচ্ছেদ করার অধিকার স্ত্রীদের ছিল।
  • যীশুর কথার সারাংশে বলা যায় যে, বিবাহবিচ্ছেদ নিষিদ্ধ নয়, যদি তা আইনগত প্রক্রিয়া দ্বারা অর্থাৎ বৈধভাবে ও মোশির আইন-কানুনের ৪টি গ্রহণযোগ্য কারণে হয়। কিন্তু আইনগতভাবে বিবাহবিচ্ছেদ না করে পুনরায় বিবাহ করা, তা ব্যভিচার বলে নিষিদ্ধ – নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য।
  • যীশু কি তাহলে হিল্লেলের সাথে একমত (যে কোন কারণে বিবাহবিচ্ছেদ) বা শাম্মার সাথে একমত (মাত্র ৪টি গ্রহণযোগ্য কারণ)? তিনি বলেন “যে কেউ ব্যভিচারের দোষ ছাড়া অন্য কোন কারণে স্ত্রীকে ছেড়ে দিয়ে অন্যকে বিয়ে করে সে ব্যভিচার করে”। খুব সম্ভবত, য‌খন যীশু এখানে ‘ব্য‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌ভিচারের দোষ’ বলেন, তিনি মাত্র ব্যভিচারকে বুঝান না, বরং তিনি মোশির আইন-কানুনের ৪টি গ্রহণযোগ্য কারণগুলো বুঝান, – যা নিয়ে সবাই একমত ছিল। পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় যে, যীশু এখানে হিল্লেলের ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে দাঁড়ান, অর্থাৎ গ্রহণযোগ্য ৪টি কারণ ছাড়া “অন্য কোনো কারণে” বিবাহবিচ্ছেদ করলে, তবে তা বৈধভাবে বিবাহবিচ্ছেদ হবে না এবং পুনর্বিবাহ করলে তা ‘ব্যভিচার’ হিসাবে ধরা হবে।
মথি ৫:৩১-৩২ বিবাহবিচ্ছেদ করা বা বিবাহবিচ্ছেদ-প্রাপ্ত ব্যক্তিকে বিবাহ করা

”আবার বলা হয়েছে, ‘যে কেউ তার স্ত্রীকে ছেড়ে দেয় সে তাকে ত্যাগ-পত্র দিক।’ ৩২ কিন্তু আমি তোমাদের বলছি, যে কেউ ব্যভিচারের দোষ ছাড়া অন্য কোন কারণে স্ত্রীকে ছেড়ে দেয় সে তাকে ব্যভিচারিণী করে তোলে। আর যাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে সেই স্ত্রীকে যে বিয়ে করে সেও ব্যভিচার করে।’”

লূক ১৬:১৮ বিবাহবিচ্ছেদের পরে পুনরায় বিবাহ = ব্যভিচার?
“যে কেউ নিজের স্ত্রীকে ছেড়ে দিয়ে আর একজনকে বিয়ে করে সে ব্যভিচার করে। স্বামী যাকে ছেড়ে দিয়েছে সেই রকম স্ত্রীকে যে বিয়ে করে সেও ব্যভিচার করে।”
  • যখন যীশু এই কথাগুলো বলেন, তিনি ফরীশীদেরকে ধমক দেন যে তারা ‘ধার্মিকতা দেখায়’, কিন্তু তাদের হৃদয় ও মনের চিন্তা খাঁটি নয়। এই প্রসঙ্গে যীশু আবার বিবাহবিচ্ছেদের বিষয় ওঠান। এর পরেই তিনি গরীব লাসারের দৃষ্টান্ত বলেন এবং শেষে এভাবে তাদের দোষ দরেন “মোশি ও নবীদের লেখা বই তো তাদের কাছে আছে। ওরা তাঁদের কথায় মনোযোগ দিক” (লূক ১৬:২৯)। যীশু খুব পরিষ্কারভাবে দেখান যে, তারা প্রকৃতপক্ষে মোশির আইন-কানুন ও কথা মানতে রাজি নয়।
  • মথি এবং লূক এখানে সংক্ষেপে ‘ব্যভিচারকে’ বিবাহবিচ্ছেদের গ্রহণযোগ্য কারণ হিসাবে সরাসরি উল্লেখ করেন। তবুও খুব সম্ভবত, যীশু ব্যভিচারের উল্লেখ দ্বারা বিবাহবিচ্ছেদের ৪টি গ্রহণযোগ্য কারণ বুঝান এবং তাঁর শ্রোতারাও তাঁর কথা এভাবে বুঝত। তাই যখন যীশু সংক্ষেপে বলেন ”ব্যভিচারের দোষ ছাড়া”, এটা দ্বারা তিনি মোশির আইন-কানুনে (যাত্রা ২১:১০-১১) বিবাহবিচ্ছেদের গ্রহণযোগ্য কারণ (খাবার, পোশাক, সহবাসের ক্ষেত্রে অবহেলা) বাতিল করেন না। এই ৪টি কারণ নিয়ে হিল্লেল এবং শাম্মার ব্যাখ্যা সমর্থনকারী ফরীশীরা সবাই একমত ছিল। যীশুর উক্তি “যে কোন কারণে” পরিষ্কারভাবে হিল্লেলের বিবাহবিচ্ছেদ সম্পর্কিত ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে।
  • লূক বিষয়টি আরো সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করেন, তিনি ব্যভিচারও গ্রহণযোগ্য কারণ হিসাবে আর উল্লেখ করেন না, অন্য ৩টি কারণও উল্লেখ করেন না, কিন্তু যীশুর শ্রোতারা যীশুর কথা শুনে অবশ্যই বিবাহবিচ্ছেদের এই ৪টি গ্রহণযোগ্য কারণ মনে মনে যোগ দিত।
  • এই ব্যাখ্যার সমর্থনে বলা যায় যে, রব্বীদের সাহিত্যে এই ধরণের সংক্ষিপ্ত কথা প্রায়ই পাওয়া যায়, অর্থাৎ যা নিয়ে কারও দ্বিমত ছিল না, একারণে বেশিরভাগ সময়ে বিস্তারিত উল্লেখ করা প্রয়োজনও হত না।
মথি ১৯:১০ “বিয়ে না করাই ভাল”

“’তখন তাঁর শিষ্যেরা তাঁকে বললেন, “স্বামী-স্ত্রীর সম্বন্ধ যদি এই রকমেরই হয় তাহলে তো বিয়ে না করাই ভাল।” ১১ যীশু তাঁদের বললেন, “সবাই এই কথা মেনে নিতে পারে না; কেবল যাদের সেই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তারাই তা মেনে নিতে পারে। ১২ কেউ কেউ খোজা হয়ে জন্মগ্রহণ করে, সেইজন্য তারা বিয়ে করে না। আর কাউকে কাউকে মানুষেই খোজা করে, সেইজন্য তারা বিয়ে করে না। আবার এমন কেউ কেউ আছে যারা স্বর্গ-রাজ্যের জন্য বিয়ে করবে না বলে মন স্থির করে। যে এই কথা মেনে নিতে পারে সে মেনে নিক।’”

  • হয়তো, কঠিন হৃদয়ের ফরীশীরা যীশুর কথায় বেশি সাড়া দেয় নি, কিন্তু শিষ্যেরা যীশুর কথায় সাড়া দেয় এবং তারা মন্তব্য করে বলে যে, “যদি এই রকমেরই হয় তাহলে তো বিয়ে না করাই ভাল”, অর্থাৎ নারীদের ক্ষেত্রে যে শর্ত ও নিয়ম দেওয়া হয়েছে, যদি তা একইভাবে পুরুষদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, তবে “বিয়ে না করাই ভাল”। এখানে আমরা তাদের মনের চিন্তার অত্যন্ত সৎ প্রকাশ পাই!
  • বিবাহবিচ্ছেদের বিষয়ে যীশুর এত শর্ত ও সীমাবদ্ধ ব্যাখ্যায় শিষ্যেরা অবাক হয়। তাদের অবাক লাগে যে, বিবাহবিচ্ছেদের চেয়ে যীশু ক্ষমা করতে বলেন। যীশু হিল্লেলের ব্যাখ্যায় একমত নন এবং তিনি পুরুষদের ক্ষেত্রেও বহুবিবাহ নিষেধ করেন। সম্ভবত, তাদের মনেও এই চিন্তা প্রচলিত ছিল যে, নারীদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য পুরুষদের হাতে বিবাহবিচ্ছেদের হুমকি থাকা ভাল। অথবা, পুরুষ যদি স্ত্রীর উপরে তার নিয়ন্ত্রণ হারায়, সেক্ষেত্রে যেন সে সহজেই প্রথম বিবাহ থেকে বের হতে পারে। একারণে উপরোক্ত উক্তিতে শিষ্যদের কথায় ভয় প্রকাশিত।
  • পরবর্তীতে, যীশু তাদের কাছে আরও অবাক হওয়ার মত কথা বলেন যে, বিবাহ আবশ্যক নয়, সন্তান নেওয়াও আবশ্যক নয়, কেউ কেউ “স্বর্গ-রাজ্যের জন্য বিয়ে করবে না”, এমন উপায় অবলম্বন করা যায়! যিহূদীরা আদি ১:২৮ পদ এভাবে ব্যাখ্যা করত যে, বিবাহ বাধ্যতামূলক এবং সন্তান নেওয়াও বাধ্যতামূলক। সর্বনিম্ন কতজন সন্তান জন্মদান করলে এই আইন পূর্ণ করা সম্ভব, এই বিষয়ে রব্বী হিল্লেল ও রব্বী শাম্মার মধ্যে মতভেদ ছিল। একারণে অনেকে বলে যে পৌল নিশ্চয়ই বিবাহিত বা বিপত্নীক ছিলেন। যিহূদী ছেলেরা সাধারণত কিশোর বয়সে বিবাহ করে পরিবার গঠন করত। তাই যখন যীশু ৩০ বছর বয়স পর্যন্তও অবিবাহিত ছিলেন, তিনি নিশ্চয় অনেক ধরণের মন্তব্যের স্বীকার হয়েছিলেন।
  • যীশুকে নিয়ে মরিয়মের গর্ভবস্থা নিশ্চয়ই অনেক গুজব-গল্পের ছিল, এমন লজ্জা যা কখনও সম্পূর্ণভাবে মুছে ফেলা সম্ভব ছিল না। তবুও যীশু বিভিন্ন যিহূদী সমাজ গৃহে এবং যিরুশালেমের উপাসনা-ঘরে প্রবেশ করতেন। পরবর্তী যুগে যিহূদী রব্বীদের লেখায় যীশুকে অবৈধ সন্তান বলে ঘোষণা করা হয়।
  • “কেউ কেউ খোজা হয়ে জন্মগ্রহণ করে, সেইজন্য তারা বিয়ে করে না। আর কাউকে কাউকে মানুষেই খোজা করে, সেইজন্য তারা বিয়ে করে না”, রব্বীদের লেখাগুলোতেও এই দু’টি দলের উল্লেখ পাওয়া যায়।
  • কিন্তু যীশু একটি তৃতীয় দল যুক্ত করেন, তা হল: “কেউ কেউ আছে যারা স্বর্গ-রাজ্যের জন্য বিয়ে করবে না বলে মন স্থির করে” , এ বিষয়ে রব্বীদের লেখাগুলোতে কোন উল্লেখ ছিল না।
  • ‘ধর্মীয় জীবন-যাপনের জন্য নিজেকে খোজা করা’ (self-mutilation), এই ধরণের বিষয় যিহূদী চিন্তা, সংস্কৃতি বা অনুশীলনে একদম নেই।
  • কিন্তু তাহলে যীশু এর অর্থ কি বুঝান? তিনি এখানে স্বেচ্ছায় বিবাহ না করার এবং সন্তান না নেওয়ার অনুমতি দেন। এমন কি, তিনি তা ভাল বিষয় বলেন এবং তা ‘একটি সম্ভাব্য পথ’ হিসাবে দেখান, – যা যিহূদীদের জন্য আচমকানোর বিষয়।
ইনস্টন-ব্রূয়ার (Instone-Brewer): ‘বিবাহবিচ্ছেদ ও পুনর্বিবাহ’ সম্বন্ধীয় যীশুর উক্তিগুলো পুরাতন নিয়মের শাস্ত্রাংশের ভিত্তিতে গঠিত
  • ৪টি সুসমাচার থেকে ‘বিবাহবিচ্ছেদ সম্বন্ধীয়’ যীশুর উক্তিগুলো এবং শ্রোতাদের কাছে উক্তিগুলোর পরিষ্কার অর্থ একত্রিত করে, যীশু ও ফরীশীদের আলোচনা নিচে উল্লেখ করা হল:

”তখন কয়েকজন ফরীশী যীশুকে পরীক্ষা করবার জন্য তাঁর কাছে এসে বললেন, “মোশির আইন-কানুন মতে যে কোন কারণে স্ত্রীকে ছেড়ে দেওয়া কি কারও পক্ষে উচিত” (দ্বিতীয় বিবরণ ২৪:১) যেমন হিল্লেলের ব্যাখ্যা সমর্থকেরা বলে?” উত্তরে যীশু বললেন, “আপনারা কি পড়েন নি, সৃষ্টিকর্তা প্রথমে তাঁদের পুরুষ ও স্ত্রীলোক করে সৃষ্টি করেছিলেন (আদি ১:২৭) আর বলেছিলেন, ৫ ‘এইজন্যই মানুষ মা-বাবাকে ছেড়ে তার স্ত্রীর সংগে এক হয়ে থাকবে আর তারা দু’জন একদেহ হবে’ (আদি ২:২৪)? ৬ এইজন্য তারা আর দুই নয়, কিন্তু একদেহ। তাই ঈশ্বর যা একসংগে যোগ করেছেন মানুষ তা আলাদা না করুক।’ “
তখন ফরীশীরা তাঁকে বললেন, “তাহলে মোশি কেন ত্যাগপত্র দিয়ে স্ত্রীকে ছেড়ে দিতে আদেশ করেছেন (দ্বিতীয় বিবরণ ২৪:১)?”
যীশু তাদের বললেন, “আপনাদের মন কঠিন বলেই স্ত্রীকে ছেড়ে দিতে মোশি আপনাদের অনুমতি দিয়েছেন, যেমন- যিরমিয় ৪:৪ পদে, ইস্রায়েল জাতি যখন ব্যভিচার অর্থাৎ দেবতাপূজা থেকে মন ফিরাতে প্রত্যাখ্যান করেছিল। কিন্তু প্রথম থেকে এই রকম ছিল না।
পরবর্তীতে তিনি শিষ্যদের বললেন “আমি আপনাদের বলছি, যে কেউ ব্যভিচার, খাবার, পোশাক ও যৌনতা বা সহবাসের অভাবের (যাত্রা ২১:১০-১১) দোষ ছাড়া অন্য কোন কারণে স্ত্রীকে ছেড়ে দেয়, তবে বিবাহবিচ্ছেদ করার বিষয়ে তার কোনো গ্রহণযোগ্য কারণ নেই। এক্ষেত্রে বিবাহবিচ্ছেদ আইনগত ও বৈধ নয়। ফলে যদি সে অন্য একজনকে বিয়ে করে, তবে সে তার আগের স্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যভিচার করে (কারণ বহুবিবাহ নিষিদ্ধ) এবং সে তার আগের স্ত্রীকে ব্যভিচারী বানায়, কারণ ছেড়ে দেওয়া স্ত্রীর তো নতুন বিবাহ করতেই হবে। তাই দু’জন দোষী হয়ে যায়।”
শিষ্যেরা তাঁকে বললেন, “স্বামী-স্ত্রীর সম্বন্ধ যদি এই রকমেরই হয়, অর্থাৎ যদি পুরুষের উপরও এত শর্ত রাখা হয়, তাহলে তো বিয়ে না করাই ভাল।” যীশু তাঁদের বললেন, “সবাই এই কথা মেনে নিতে পারে না; কেবল যাদের সেই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তারাই তা মেনে নিতে পারে। কেউ কেউ খোজা হয়ে জন্মগ্রহণ করে, সেইজন্য তারা বিয়ে করে না। আর কাউকে কাউকে মানুষেই খোজা করে, সেইজন্য তারা বিয়ে করে না। আবার এমন কেউ কেউ আছে যারা স্বর্গ-রাজ্যের জন্য বিয়ে করবে না বলে মন স্থির করে। বিবাহ করা এবং সন্তান জন্মদান আবশ্যক নয়। যে এই কথা মেনে নিতে পারে সে মেনে নিক।’”

লূক ৭:৩৬-৫০ যীশুর অনুগ্রহ ও দয়ার প্রকাশ > একজন পাপী স্ত্রীলোক তাঁকে অভিষিক্ত করে

“তাই আমি তোমাকে বলছি, সে বেশী ভালবাসা দেখিয়েছে বলে বুঝা যাচ্ছে যে, তার পাপ অনেক হলেও তা ক্ষমা করা হয়েছে। যার অল্প ক্ষমা করা হয় সে অল্পই ভালবাসা দেখায়।”

  • যে অনুতপ্ত হতে রাজি, তার জন্য অবশ্যই ক্ষমা আছে। এই স্ত্রীলোক নিজের পাপ জানে, সে অজুহাত দেখায় না বা পাপের পক্ষে ন্যায্যতা প্রমাণ করে না বরং ক্ষমার আশায় আসে। ক্ষমা পেয়ে ভবিষ্যতে তার কি করা অনুমোদিত (বিয়ে করার অনুমতি রয়েছে কি?), এবিষয়ে এখানে কোন উল্লেখ নেই।
যোহন ৮:১-১১ যীশুর অনুগ্রহ ও দয়া প্রকাশ > ব্যভিচারী স্ত্রীলোককে ক্ষমা

“যীশু উঠে সেই স্ত্রীলোকটিকে বললেন, “তাঁরা কোথায়? কেউ কি তোমাকে শাস্তির উপযুক্ত মনে করেন নি?” ১১ স্ত্রীলোকটি উত্তর দিল, “না গুরু, কেউই করেন নি।” তখন যীশু বললেন, “আমিও করি না। আচ্ছা যাও; পাপে জীবন আর কাটায়ো না।”

  • একটু বাস্তব চিন্তা করুন – একটি ব্যভিচার যেন ‘সেই মুহূর্তে ধরা পড়ে’, যেন সাক্ষী বলতে কেউ থাকে, তার সম্ভাবনা বেশ কম। পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় যে, যীশুর জন্য এই ফাঁদ তৈরি করার জন্য ফরীশী ও ধর্ম-শিক্ষকদের কত তদন্ত, কৌশল ও পরিকল্পনা করা দরকার ছিল। বাস্তবভাবে চিন্তা করলে বুঝা যায় যে, সম্ভবত এই ব্যভিচার রীতিমত ঘটত, তাই তারা তা ‘ব্যবহার’ করতে সক্ষম হয়। তারা এই অবৈধ ব্যবহার প্রতিরোধ করত না, বাধা দিত না কিন্তু এখানে যীশুর বিরুদ্ধে ব্যবহার করে। দেখা যায় তাদের হৃদয় কত কঠিন।
  • যীশু তাদের বিচারে একমত নন। তারা ব্যভিচারী পুরুষকে ছেড়ে দিয়ে মাত্র ব্যভিচারী নারীকে বিচার করতে চায় (যদিও আইন-কানুন অনুসারে, পুরুষ ও নারী দু’জনকেই শাস্তি দিতে হবে লেবীয় ২০:১০)।
  • যীশু – যিনি খাঁটি – তিনি নারীকে বিচার করতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা করেন না বরং তাকে রক্ষা ও ক্ষমা করেন। তবুও তিনি তাকে পাপ আর না করতে বলেন।
  • ব্যভিচার – পাপ হিসাবে সবাই খারাপ বলে (বিশেষভাবে নারীদের ক্ষেত্রে) – সেই পাপের জন্য তারা নারীকে বিচার করতে চায়। কিন্তু যীশু সব ধরণের পাপ একইভাবে দেখেন, তিনি তাদের চেতনা দেন এবং তাদের নিজেদের হৃদয়কে চ্যালেঞ্জ করতে বলেন।

যীশুর শিক্ষা থেকে ব্যবহারিক নীতিসমূহ

যীশুর শিক্ষার ৬টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যিহূদীদের ব্যবহারিক জীবন ও শিক্ষা থেকে ভিন্ন। আমরা এগুলো প্রায় লক্ষ্য করি না, কিন্তু যিহূদী সংস্কৃতির জন্য তা আসলে একটি বিপ্লবীয় আশীর্বাদ, নিচে তা নিয়ে আলোচনা করা হল:

  • ১ একবিবাহ প্রতিষ্ঠা, অর্থাৎ বহুবিবাহ মাত্র নারীদের জন্য না বরং পুরুষদের জন্যও নিষিদ্ধ।
  • ২ বিবাহ আজীবন।
  • ৩ ব্যভিচারের ফলে বিবাহবিচ্ছেদ বাধ্যতামূলক নয়।
  • ৪ বিশেষ কিছু কারণে বিবাহবিচ্ছেদ অনুমোদিত।
  • ৫ বিবাহ করা আবশ্যক নয়।
  • “যে কোন কারণে” বিবাহবিচ্ছেদ বৈধ নয়।
১) একবিবাহ
  • কোনো ব্যক্তি কেবলমাত্র একজনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ থাকতে পারে। বহুবিবাহ করা নিষেধ।
  • প্রকৃতপক্ষে, যীশুর সময় থেকে বহুবিবাহের প্রচলন ধীরে ধীরে হ্রাস পায়। বহুবিবাহ বেশিরভাগ প্রচলিত ছিল খুব ধনীদের মধ্যে, গরীবদের মধ্যে কম।
  • বহুবিবাহ হ্রাস পাওয়ার সাথে নারী-পুরুষের অধিকারের মধ্যে পার্থক্যও হ্রাস পায়।
  • বহুবিবাহের নামে পুরুষদের ব্যভিচার যেন আর অজুহাত হিসাবে ব্যবহৃত না হয় বরং ব্যভিচার হিসাবে চিহ্ণিত হয়, তা যীশু স্থাপন করেন। ফলে স্ত্রী স্বামীর অবিশ্বস্ততা অর্থাৎ ব্যভিচারকে বিবাহবিচ্ছেদের গ্রহণযোগ্য কারণ হিসাবে ব্যবহার করতে পারবে।
  • বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ বর ও কনে উভয়েই শপথ করে যে, শুধুমাত্র তাদের পরস্পরের মধ্যে যৌন-সম্পর্ক বজায় থাকবে। অর্থাৎ, দাম্পত্য জীবনে যৌনতার ক্ষেত্রে তারা পরস্পরের প্রতি বিশ্বস্ততা বজায় রাখবে।
  • একবিবাহ স্থাপনের একটি নেতিবাচক প্রভাব হল: বিধবা ও বিবাহবিচ্ছেদ-প্রাপ্ত নারীদের পুনর্বিবাহ করা আরো কঠিন হয়ে যায়। বিধবা ও বিবাহবিচ্ছেদ-প্রাপ্ত নারীদের সাধারণত ২য় স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করা হত। তাই বহুবিবাহ নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে বিবাহের জন্য স্বামী খুঁজে পাওয়া স্বাভাবিকভাবে আরও কঠিন হয়।
  • পৌল অল্পবয়সী বিধবাদের পুনরায় বিবাহ করতে এবং বয়স্ক বিধবাদের ভাল শিক্ষক ও পরামর্শদাতা হিসাবে আদর্শ হতে উৎসাহিত করেন।
  • প্রথম মণ্ডলীর কিছু লেখা বা রেকর্ড থেকে জানা যায় যে, রোমীয় মণ্ডলী ১৫০০জন এবং আন্তিয়খিয়া মণ্ডলী ৩০০০ জন বিধবা বা অবিবাহিত নারীদের জন্য নিয়মিত যোগান দিত। এ থেকে বুঝা যায় যে, মণ্ডলী এবিষয়ে কত বেশি গুরুত্ব দিত।
২) বিবাহ আজীবন
  • বিবাহের সম্পর্ক আজীবন হওয়া উচিত, অর্থাৎ কোন একজনের মৃত্যু পর্যন্ত দু’জনের সমর্পিত ও বিশ্বস্ত থাকা দরকার। মৃত্যুর আগে এটি ভেঙ্গে ফেলা মানে ‘ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরুদ্ধে’ যাওয়া।
  • যীশু এক্ষেত্রে যিহূদীদের সাধারণ চিন্তার সাথে একমত। এই বিষয়টি যে কত বেশি গুরুত্বপূর্ণ পরবর্তী পয়েন্টের সংযোগে তা প্রকাশ পায়:
৩) ব্যভিচারের পরে বিবাহবিচ্ছেদ বাধ্যতামূলক নয়
  • যিহূদী রব্বীরা শিক্ষা দিত যে, দাম্পত্যদের কোন একজন যদি ব্যভিচার করে তবে বিবাহবিচ্ছেদ আবশ্যক। রব্বীদের এই সরু ব্যাখ্যায় যীশু দ্বিমত।
  • যিহূদী আইন ও চিন্তা অনুসারে, এক্ষেত্রে সন্দেহ হলে তেতো জলের প্রক্রিয়া প্রয়োগ করা হত (গণনা ৫:২১-৩১)। তবুও এ প্রক্রিয়া অনুসারে স্ত্রী নির্দোষ হিসাবে প্রমাণিত হলেও স্বামীর তার সাথে বিবাহবিচ্ছেদ করার অধিকার ছিল। যে স্বামীরা স্ত্রীদের ভালবাসত, তারা সাধারণত তাদের স্ত্রীদের তেতো জলের প্রক্রিয়ায় বাধ্য করত না।
  • যীশুর শিক্ষার একটি ইতিবাচক ফলাফল ছিল যে, তার শিক্ষা অনুসারে ব্যভিচারী স্ত্রীদের ক্ষমা করার অনুমতি স্বামীদের ছিল। একারণে ক্ষমা করার জন্য স্বামীদের আর ‘অধার্মিক’ হিসাবে দেখা হত না।
  • একইভাবে স্ত্রীদেরও ব্যভিচারী স্বামীদেরকে ক্ষমা করার অনুমতি রয়েছে এবং এখন এটি ‘ক্ষমার বিষয়’ হিসাবে স্বীকৃতি পায়, কিন্তু আগে তা (বহুবিবাহের কারণে) ছিল জোরপূর্বক ‘মেনে নেওয়ার’ বিষয় মাত্র।
  • রব্বীদের শিক্ষা অনুসারে, স্ত্রী অন্য পুরুষের সাথে কথা বললে, সন্দেহের ফলে স্বামী স্ত্রীকে সাবধানবাণী দিবে, দ্বিতীয়বার একই রকম হলে সেক্ষেত্রে বিবাহবিচ্ছেদ করতে হবে। যীশুর শিক্ষার নীতি অনুসারে, এমন আবশ্যিক বিবাহবিচ্ছেদ আর বাধ্যতামূলক নয়। যীশুর এই নীতি নারীদের স্বাধীনতা অবশ্যই বাড়িয়ে দেয়।
৪) বিশেষ কিছু কারণে বিবাহবিচ্ছেদ অনুমোদিত
  • যীশুর নীতি অনুসারে, দাম্পত্য সঙ্গী যদি বার বার বিবাহের শপথ ভাঙ্গে, তবে তা ‘বিবাহবিচ্ছেদের গ্রহণযোগ্য কারণ’ হিসাবে দাঁড়ায়, অর্থাৎ সঙ্গী বিবাহবিচ্ছেদ দাবি করতে পারে। তার যৌতুক পাওয়ার অধিকার আছে।
  • ‘বিবাহবিচ্ছেদের গ্রহণযোগ্য কারণগুলো’ কি কি? মোশির আইন-কানুনের ৪টি গ্রহণযোগ্য কারণ হল (ব্যভিচার, খাবার, পোশাক ও সহবাসের অভাব, যাত্রা ২১:১০-১১)। তবে “যে কোন কারণে” বিবাহবিচ্ছেদ করা পাপ। অর্থাৎ বন্ধ্যাত্বের কারণে সন্তান জন্মগ্রহণ ব্যাহত হলে, তা বিবাহবিচ্ছেদের গ্রহণযোগ্য কারণ নয়। সন্তান জন্মগ্রহণের জন্য কত সময় অপেক্ষা করা উচিত, এই বিষয়ে নতুন ও পুরাতন নিয়মে কোন কিছু উল্লেখ নেই। এমনকি রব্বীদের লেখাতেও বেশি কিছু পাওয়া যায় না।
৫) বিবাহ আবশ্যক নয়
  • বিবাহ আবশ্যক নয়। তাই সন্তান জন্মদানও আবশ্যক নয়। নেওয়াও আবশ্য নয়। তাই সন্তান না থাকা বিবাহবিচ্ছেদের গ্রহণযোগ্য কারণ হিসাবে দাঁড়ায় না।
  • রব্বীদের শিক্ষা অনুসারে, ১০ বছরের মধ্যে সন্তান জন্মগ্রহণ ব্যাহত হলে, তবে বিবাহবিচ্ছেদের অনুমোদন রয়েছে। কেউ কেউ এক্ষেত্রে বিবাহবিচ্ছেদ আবশ্যক বা বাধ্যতামূলক বলত।
  • যীশু এই চিন্তা বা আইন বাতিল করেন। আদি ১:২৮ পদ তিনি ‘আবশ্যিক বিবাহ সম্বন্ধীয় ঈশ্বরের আদেশ’ হিসাবে নেন না (‘ফলবান হতেই হবে!’ ‘সন্তান জন্মদান করতেই হবে!’)। তাই নিঃসন্তান হওয়া পাপ নয়।
৬) “যে কোন কারণে” বিবাহবিচ্ছেদ করা অনুমোদিত না
  • যীশু এখানে হিল্লেলের ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে যান। যীশু দাবি করেন যে, ৪টি গ্রহণযোগ্য কারণ ছাড়া অন্য কোন কারণে বিবাহবিচ্ছেদ করা পাপ। এর অর্থ হল: “যে কোন কারণে” বিবাহবিচ্ছেদের পরে পুনর্বিবাহ করা ব্যভিচার হিসাবে বিবেচিত হওয়ায় দ্বিতীয় বিবাহের সন্তানেরা অবৈধ বা জারজ সন্তান।
  • সম্ভবত, যীশুর সময়ে যিহূদীরা আগের যুগের চেয়ে বিবাহবিচ্ছেদ হালকা বিষয় হিসাবে দেখত।
  • সম্ভবত, যীশুর শ্রোতারা চিন্তা করত যে, যদিও যীশু এধরণের বিবাহবিচ্ছেদ অনুমোদিত করেন না, তবুও বিবাহবিচ্ছেদ বাস্তবায়ন হলে তিনি তা মেনে নিবেন। সাধারণত, হিল্লেলীয় ও শাম্মার রব্বীরা পরস্পর আদালত সংঘটিত বিবাহবিচ্ছেদ সম্বন্ধীয় রায় মেনে নিত, বর্তমানে যেভাবে এক মণ্ডলীতে সংঘটিত বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদ অন্য মণ্ডলী গ্রহণ করে।
  • যীশু এখানে যিহূদী সমাজের চেয়ে অনেক কঠোর: তিনি মাত্র মোশির আইন-কানুন থেকে আসা ৪টি কারণ বিবাহবিচ্ছেদের গ্রহণযোগ্য কারণ হিসাবে মানতেন। এছাড়া তিনি ক্ষমা করার মাধ্যমে বৈবাহিক সম্পর্ক বজায় রাখার বিষয়ে সমর্থনকারী।
  • যীশুর অনুসরনকারীদের এখানে কি করা উচিত? দ্বিতীয় বিবাহ বাতিল করে প্রথম বিবাহে ফিরে যেতে কি চেষ্টা করা? “যে কোন কারণে” বিবাহবিচ্ছেদের পরে পুনরায় বিবাহ না করা? যীশু অবশ্যই এখানে মামলা করার নির্দেশ দেন না। হয়তো একারণে তিনি বলেছিলেন “যে এই কথা মেনে নিতে পারে সে মেনে নিক’”
যীশু কি ‘ব্যভিচার’ ছাড়াও ‘অন্য কোন কারণ’ বিবাহবিচ্ছেদের জন্য গ্রহণযোগ্য’ বলেছেন?
  • ৪টি সুসমাচারে এই বিষয়ে যীশুর কোন সরাসরি উক্তির উল্লেখ নেই, তাই আমাদের এ বিষয়ের ক্ষেত্রে সাবধানে উপসংহারে আসতে হবে:
    • ১) ব্যভিচারের পাশাপাশি অন্য ৩টি গ্রহণযোগ্য কারণ যীশু সরাসরি উল্লেখ করেন না। তবে তিনি বেশ কিছু বিষয়ে এমন কিছু বলেন, যা রব্বীদের ব্যাখ্যাকে চ্যালেঞ্জ করে, যেমন: মাত্র একবিবাহ অনুমোদিত, বহুবিবাহ নিষেধ; বিবাহ আজীবন-ব্যাপী; বিবাহবিচ্ছেদ আবশ্যক নয়, বিবাহবিচ্ছেদ কিছু বিশেষ কারণে অনুমোদিত; ‘যে কোন কারণে’ বিবাহবিচ্ছেদ অনুমোদিত না, নিঃসন্তান হওয়া বিবাহবিচ্ছেদের কারণ না।
    • ২) সরাসরিভাবে উল্লেখ না করলেও, যীশু যখন ‘ব্যভিচার’ উল্লেখ করেন, তিনি প্রকৃতপক্ষে মোশির আইনের ৪টি গ্রহণযোগ্য কারণ বুঝান।
    • ৩) রব্বী শাম্মার মত যীশু নিজেও “যে কোন কারণে” বিবাহবিচ্ছেদ আবশ্যক, এতে একমত নন। রব্বী শাম্মা ও যীশু উভয়েই মোশির আইনের মাত্র ৪টি গ্রহণযোগ্য কারণকে সমর্থন করেন (যাত্রা ২১:১০-১১)। এছাড়াও যীশু ও রব্বী শাম্মার চিন্তা ও কথা বলার ধরণ এক। রব্বী শাম্মার সাথে একমত না হলে যীশুর কথায় তা প্রকাশ হত।

‘বিবাহ বিষয়ক’ পৌলের মন্তব্য

  • ‘বিবাহ বিষয়ক’ পৌলের বিভিন্ন মন্তব্য সারাংশে দেওয়া হল:
    • ‘দাম্পত্য জীবনে স্বামী-স্ত্রীর অধিকার ও কর্তব্য
    • বিবাহবিচ্ছেদের বিরুদ্ধে যীশুর শিক্ষা
    • কারও ইচ্ছার বিরুদ্ধে যদি বিবাহবিচ্ছেদ হয় (৪টি গ্রহণযোগ্য কারণগুলোর ভিত্তিতে না হলেও) পুনরায় বিবাহ করা চলবে
    • বিবাহ আবশ্যিক নয় বা ব্যবহারিক কারণে পিছানো যায়
    • বিবাহবিচ্ছেদের গ্রহণযোগ্য কারণগুলোর সরাসরিভাবে উল্লেখ নেই।
    • বিবাহিত সঙ্গীকে ত্যাগ করা (আইনগত প্রক্রিয়া ছাড়া), তা ঠিক না।
    • ত্যাগপত্র ছাড়া পরিত্যাগ করা অন্যায় হিসাবে তিনি বিবেচিত করেন।
  • গ্রীক ও রোমীয় সংস্কৃতিতে স্ত্রীকে স্বেচ্ছায় বিবাহবিচ্ছেদ করার বিষয়ে স্বামীর অধিকার ছিল। বিবাহিত জীবন ত্যাগ করার অভিপ্রায়ে স্বামী যদি স্ত্রীকে পরিত্যাগ করে চলে যেত, অথবা যদি স্ত্রীকে জোর-পূর্বক ঘর থেকে বের করত, তবে তা আইনগত বিবাহবিচ্ছেদ হিসাবে ধরা হত। এক্ষেত্রে, স্বামীকে আগে সাবধানবাণী দেওয়ার দাবি ছিল না, বিবাহবিচ্ছেদ প্রতিরোধের প্রচেষ্টার প্রক্রিয়াও ছিল না, বিবাহবিচ্ছেদের কারণও ঘোষণা করা হত না। যদি বিচ্ছেদের কারণ ঘোষণা করা হত, যে কোনো কিছু কারণ হিসাবে দাঁড় করানো যেত (যেমন ‘স্ত্রী আর সুন্দরী নয়’)। বিবাহবিচ্ছেদের প্রচলনের বিষয়ে গ্রীক ও রোমীয় সমাজে নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান উল্লেখ না থাকলেও, বিভিন্ন গল্প-কাহিনী ও লেখা থেকে ধারণা করা যায় যে, বিবাহবিচ্ছেদের হার তুলনামূলকভাবে অনেক উঁচুতে ছিল। গ্রীক ও রোমীয় বৈবাহিক চুক্তি পত্রগুলোতে বিধবা ও বিপত্নীকের বিষয়ে উল্লেখ খুব কম পাওয়া যায়, বিবাহবিচ্ছেদের বিষয় বেশি পাওয়া যায়। সম্ভবত, বৈবাহিক জীবন মৃত্যু পর্যন্ত বা আজীবন-ব্যাপী, এই চুক্তিবদ্ধ জীবনের বিশ্বস্ততা রক্ষার বিষয়ে আশা তাদের মধ্যে ছিল না।
  • বৈবাহিক বিষয়ে গ্রীক ও রোমীয়দের তুলনায় যিহূদীদের চিন্তা আরও উঁচু মানের ছিল। বিবাহ রক্ষার বিষয়ে যিহূদী পুরুষ ও নারী উভয়েরই দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল, এছাড়াও বিবাহবিচ্ছেদের বিষয়ে উল্লেখযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য কারণ প্রতিষ্ঠিত হলেও ত্যাগ-পত্র প্রয়োজন হত।
  • হিল্লেলের ব্যাখ্যা গ্রীক ও রোমীয়দের মত ৪টি গ্রহণযোগ্য কারণগুলোর পাশাপাশি ‘যে কোন কারণে’ দাঁড় করালে বিবাহবিচ্ছেদ সম্ভব ছিল। তবুও হিল্লেল দাবি করেন যে, বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে ত্যাগ-পত্র, অর্থাৎ একটি আইনগত প্রক্রিয়া থাকুক। অবশ্যই শুধুমাত্র পুরুষদের ত্যাগপত্র লেখার অধিকার ছিল। রব্বী হিল্লেল বৈবাহিক সম্পর্ক ‘মৃত্যু পর্যন্ত স্থায়ী’ এই প্রত্যাশা করতেন, যদিও বিবাহবিচ্ছেদ প্রয়োজন হতে পারে।
১ করিন্থীয় ৭:১-৯ বিবাহে মানসিক / আবেগীয় দায়িত্ব

“তোমরা আমাকে যে সব বিষয় সম্বন্ধে লিখেছ এবার তার উত্তর দিচ্ছি। যদি কেউ বিয়ে না করে তবে সে ভালই করে; ২ কিন্তু চারদিকে অনেক ব্যভিচার হচ্ছে, সেইজন্য প্রত্যেক পুরুষের নিজের স্ত্রী থাকুক আর প্রত্যেক স্ত্রীর নিজের স্বামী থাকুক। ৩ দেহের দিক থেকে স্ত্রীর যা পাওনা, তার স্বামী তাকে তা দিক; সেইভাবে স্ত্রীও স্বামীকে দিক। ৪ স্ত্রীর দেহ তার নিজের নয়, তার স্বামীর। একইভাবে স্বামীর দেহ তার নিজের নয়, তার স্ত্রীর। ৫ একে অন্যের সংগে দেহে মিলিত হতে অস্বীকার কোরো না; তবে কেবল প্রার্থনা করতে সুযোগ পাবার জন্য একমত হয়ে কিছুকাল আলাদা থাকতে পার। তার পরে আবার একসংগে মিলিত হয়ো, যেন নিজেদের দমনের অভাবে শয়তান তোমাদের পাপের দিকে টানতে না পারে। ৬ এই কথা আমি তোমাদের আদেশ দিয়ে বলছি না বরং অনুমতি দিয়েই বলছি। ৭ যদি সবাই আমার মত হত! কিন্তু ঈশ্বরের কাছ থেকে এক একজন এক একটা দান পেয়েছে। একজনের দান এক রকম, আবার অন্যজনের দান আর এক রকম।
৮ অবিবাহিত আর বিধবাদের আমি বলছি, তারা যদি আমার মত থাকতে পারে তবে তাদের পক্ষে তা ভাল। ৯ কিন্তু যদি তারা নিজেদের দমন করতে না পারে তবে বিয়ে করুক, কারণ দেহের কামনায় জ্বলে-পুড়ে মরবার চেয়ে বরং বিয়ে করা অনেক ভাল।”

  • “যদি কেউ বিয়ে না করে তবে সে ভালই করে” (আক্ষরিক: “স্ত্রীলোককে স্পর্শ না করাই ভাল”) – এই উক্তি প্রকৃতপক্ষে পৌলের নিজের নয়, পৌল এখানে করিন্থীয় মণ্ডলীর বিশ্বাসীদের একটি প্রচলিত উক্তি ব্যবহার করেন এবং পরবর্তী পদে তাদের সেই উক্তির সংশোধন করেন। ১ করিন্থীয় চিঠিতে পৌল করিন্থীয় মণ্ডলীর বিশ্বাসীদের বিভিন্ন ভুল চিন্তার উক্তি সংশোধন করেন (যেমন: ১ করিন্থীয় ৬:১২-১৩)। পদগুলোতে এই উক্তিগুলো “এটা!” নামে একটি গ্রীক শব্দ ব্যবহার করা দ্বারা পৃথক করা হয়েছে। ‘এটা’ শব্দটি ব্যবহার করা দ্বারা উল্লিখিত উক্তিতে লেখকের দ্বিমত প্রকাশ করা হয়।
  • করিন্থ শহর নৌ-বন্দর বেষ্টিত হওয়ায় আফ্রদীত মন্দিরের বেশ্যা-বৃত্তি এবং অনৈতিক জীবনের জন্য এই শহর বিখ্যাত ছিল (গ্রীক ভাষায় ‘বেশ্যা’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ ছিল- ‘করিন্থীয় স্ত্রীলোক’, অর্থাৎ ‘করিন্থীয় স্ত্রীলোক বা কন্যা’ শব্দ ‘বেশ্যা/পতিতা’ অর্থে ব্যবহৃত হত)। করিন্থীয় মণ্ডলীর বিশ্বাসীদের মধ্যেও যৌন-ঘটিত জঘন্য পাপ সংঘটিত হয় (১ করিন্থীয় ৫:১-২)। সম্ভবত একারণে বিশ্বাসীরা এই উক্তি প্রবাদ হিসাবে ব্যবহার করত যে, “স্ত্রীলোককে স্পর্শ না করাই ভাল”
  • পৌল এই কথায় একমত নন যে, ‘নারীরা খারাপ’ বা ‘বিয়ে করা ভাল নয়’ বা ‘যৌন সম্পর্ক মন্দ’। এর বিপরীতে তিনি বলেন যে, যৌনতা মন্দ নয়, অনৈতিক কিছু নয় বরং তা স্বামী-স্ত্রীর বিবাহিত জীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ (যেমন যাত্রা ২১:১০-১১ পদেও বলা হয়েছে)। এছাড়া পৌল ‘ভালবাসা দাবি করার’ অনুমতি দেন না, বিপরীতে তিনি ‘ভালবাসা দেওয়ার’ আদেশ দেন।
  • এরপর তিনি তার মতামত ব্যক্ত করেন যে, দম্পত্তি শুধুমাত্র প্রার্থনার উদ্দেশ্যে কিছু দিন আলাদা করে যৌন সম্পর্ক না রাখুক, তবে তা দীর্ঘদিন না হোক – যদিও পৌলের এই মতামত মোশির আইন-কানুনে অর্ন্তভুক্ত করা নেই। এর সমর্থনে রব্বী হিল্লেল বলতেন যে, ‘সর্বোচ্চ এক সপ্তাহ’ এবং রব্বী শাম্মা বলতেন ‘সর্বোচ্চ ২ সপ্তাহ’ স্বামী-স্ত্রীর যৌন-ক্রিয়া থেকে বিরত থাকা উচিত। সম্ভবত, পৌলও এই সময়-সীমা সমর্থন করতেন, যদিও সময়ের বিষয়ে তিনি কোনো নির্দিষ্ট সীমানা দেন না।
  • ১ করিন্থীয় ৭ অধ্যায়ে পৌল স্বামী-স্ত্রীর অধিকার ও দায়িত্বের বিষয়ে সমান্তরালভাবে উপস্থাপন করেন: পৌল বলেন যে, নারী ও পুরুষ সম্মতিক্রমে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে, তা ভাল বিষয় ও প্রয়োজনীয়, কিন্তু তিনি বৈবাহিক জীবন অবাঞ্ছিতও বলেন। তিনি বিবাহ না করার সুযোগ গ্রহণ করতে পরামর্শও দেন। কেন পৌল যিহূদীদের চিন্তার বিপরীত কিছু বলেন? কারণ পরের পদে দেখা যায় যে, পৌল ‘বর্তমান সময়কে অস্থির ও বিপজ্জনক বলে প্রকাশ করেন এবং যীশুর পুনরাগমনের সময়কাল অতি সন্নিকট’ বলে ঘোষিত করেন। সম্ভবত একারণে তিনি বিবাহিত জীবন, পরিবার গঠন ও সন্তান লালন-পালন করা কঠিন বলে মনে করেন।
  • যীশুর মত পৌলও (পুরুষ ও নারী উভয়কেই) বিবাহ না করার বিষয়ে স্বাধীনতা দেন, তবে যদি তারা যৌন সম্পর্কের আকাঙ্খা ত্যাগ করতে একমত হয়, কিন্তু বিবাহিত দম্পত্তিদের (দীর্ঘকালের জন্য) যৌন-সম্পর্ক ত্যাগ করা যাবে না।
১ করিন্থীয় ৭:৩২-৩৫ বিবাহে আর্থিক বা ব্যবহারিক দায়িত্ব

“আমি চাই যেন তোমরা ভাবনা-চিন্তা থেকে মুক্ত থাকতে পার। অবিবাহিত লোক প্রভুর বিষয়ে ভাবে; সে চিন্তা করে কিভাবে সে প্রভুকে সন্তুষ্ট করবে। ৩৩ বিবাহিত লোক সংসারের বিষয়ে ভাবে; সে চিন্তা করে কিভাবে সে স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করবে। ৩৪ এইভাবে দুই দিকই তাকে টানতে থাকে। যে মেয়ের স্বামী নেই সে এবং কুমারী মেয়ে প্রভুর বিষয়ে চিন্তা করে যাতে সে দেহে আর অন্তরে প্রভুর হতে পারে। কিন্তু বিবাহিতা স্ত্রীলোক সংসারের বিষয়ে ভাবে; সে চিন্তা করে কেমন করে সে স্বামীকে সন্তুষ্ট করবে। ৩৫ এই কথা আমি তোমাদের মংগলের জন্যই বলছি। আমি তোমাদের ধরাবাঁধার মধ্যে রাখবার জন্য তা বলছি না, বরং যা করা উচিত ও ভাল তা করবার জন্য তোমাদের উৎসাহ দিচ্ছি, যেন তোমরা সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে প্রভুর সেবা করতে পার।”

  • পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় যে, পৌল পুরাতন নিয়ম অনুসারে, বিশেষভাবে যাত্রা ২১:১০-১১ পদ অনুসারে শিক্ষা দেন। ১ করিন্থীয় ৭:১-৯ পদে তিনি সহবাসের বা দাম্পত্যের অধিকার (আবেগীয় বা যৌন অবহেলা নিষিদ্ধ) এবং ১ করিন্থীয় ৭:৩২-৩৫ পদে তিনি খাদ্য ও বস্ত্রের অধিকার (বস্তগত অবহেলা নিষিদ্ধ) তুলে ধরেন।
  • পৌল বিবাহ নিরুৎসাহিত করলে, তিনি তা কোন কারণে করেন? তিনি কিছু ব্যবহারিক দৈনন্দিন দায়িত্বগুলো কারণ হিসাবে দেখান। যেমন তিনি এখানে একটি “ভীষণ দুঃখ-কষ্টের সময়” নিয়ে কথা বলেন (১ করিন্থীয় ৭:২৬)। সম্ভবত এটি সে সময়ের অর্থাৎ ৪০-৬০ খ্রীষ্টাব্দের দুর্ভিক্ষ, খাবার-শস্যের অভাব এবং সামাজিক অস্থিরতা বুঝায়, যা পাঠকদের প্রভাবিত করেছিল। ইতিহাসবিদ সুয়েটনিয়াস, ইউসেবিয়াস এবং শাসনকর্তা প্লীনি, এই ৩জনও তা উল্লেখ করেন। ১ করিন্থীয় ১১:৩০ পদ অনুসারে, হয়তো এই দুর্ভিক্ষে করিন্থীয় মণ্ডলীর কয়েকজন বিশ্বাসীরাও মারা গিয়েছিল।
  • দুর্ভিক্ষের সময়ে বিবাহিত হওয়া, পরিবারের দায়িত্ব নেওয়া এবং যোগান নিশ্চিত করা অনেক কঠিন। ‘প্রভুর পরিচর্যা-কাজ এবং পরিবার, এই দু’টা আলাদা বিষয়, যা একসাথে করা যায় না’ – পৌল এমন বলেন নি। বরং তিনি ১ করিন্থীয় ৯:৫ পদে উল্লেখ করেন যে, পিতর ও অন্যান্য প্রেরিতেরা তাদের স্ত্রীদের সঙ্গে নিয়ে পরিচর্যা-কাজ করতেন। এছাড়াও তিনি আকিলা ও প্রিষ্কিল্লার পরিচর্যা-কাজের চমৎকার মূল্যায়ন করেন যে, তারা একসাথে মিলে প্রৈরিতিক কাজ ও শিক্ষা দান করেন (রোমীয় ১৬:৩-৪)।
  • সারাংশে বলা যায় যে, স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনের দায়িত্ব ও অধিকারের বিষয়ে পৌল সমান্তরালভাবে বর্ণনা করেন। তবে তিনি এই অনুচ্ছেদে বিবাহবিচ্ছেদ সম্পর্কিত, অর্থাৎ খাদ্য ও বস্ত্রের যোগানের বিষয়ে সরাসরি উল্লেখ করেন না, তবুও তিনি যাত্রা ২১:১০-১১ পদ সমর্থন করেন যে, দাম্পত্য জীবনে স্বামী ও স্ত্রীর পরস্পরের দায়িত্ব ও কর্তব্য নিশ্চয়ই রয়েছে। এছাড়া ‘বৈবাহিক জীবন মন্দ বা পরস্পরের দায়িত্ব অগ্রাহ্য করা উচিত’ পৌল তা-ও বুঝান না। বিপরীতে তিনি বলেন যে, বিবাহ করলে দায়িত্ব ও যত্ন নিতে হবে এবং সময় ও মূল্য দিতে হবে।
১ করিন্থীয় ৭:১০-১৫ পরিত্যাগ করা বিবাহবিচ্ছেদের বৈধ উপায় নয়

“যাদের বিয়ে হয়েছে তাদের আমি এই আদেশ দিচ্ছি-অবশ্য আমি দিচ্ছি না, প্রভুই দিচ্ছেন-স্ত্রী যেন স্বামীর কাছ থেকে চলে না যায়। ১১ কিন্তু যদি সে চলেই যায় তবে আর বিয়ে না করুক কিম্বা স্বামীর সংগে আবার মিলিত হোক। স্বামীও তার স্ত্রীকে ত্যাগ না করুক।
১২ অন্য সবাইকে অবশ্য প্রভু বলছেন না কিন্তু আমি বলছি, যদি কোন ভাইয়ের খ্রীষ্টে অবিশ্বাসী স্ত্রী থাকে আর সেই স্ত্রী তার সংগে থাকতে রাজী থাকে, তবে সেই স্বামী যেন তাকে ত্যাগ না করে। ১৩ আবার যদি কোন স্ত্রীলোকের খ্রীষ্টে অবিশ্বাসী স্বামী থাকে আর সেই স্বামী তার সংগে থাকতে রাজী থাকে, তবে সেই স্বামীকে যেন সে ত্যাগ না করে; ১৪ কারণ স্ত্রীর মধ্য দিয়ে সেই অবিশ্বাসী স্বামীকে আর স্বামীর মধ্য দিয়ে সেই অবিশ্বাসী স্ত্রীকে ঈশ্বর বিশেষ চোখে দেখেন। তা না হলে তোমাদের ছেলেমেয়েরা তো অশুচি হত; কিন্তু আসলে ঈশ্বর তাদের বিশেষ চোখে দেখেন। ১৫ কিন্তু যদি সেই অবিশ্বাসী স্বামী বা স্ত্রী চলে যেতে চায় তবে সে চলে যাক। এই রকম অবস্থায় সেই বিশ্বাসী ভাই বা বোন কোন বাঁধাবাঁধির মধ্যে থাকে না। ঈশ্বর তো আমাদের শান্তিতে থাকবার জন্যই ডেকেছেন।”

  • এই শাস্ত্রাংশ দু’ভাগ করা: প্রথম অংশে (১ করিন্থীয় ৭:১০-১১) যীশুর শিক্ষার ভিত্তিতে বিবাহবিচ্ছেদের সম্বন্ধে পৌল সরাসরি আদেশ দেন এবং দ্বিতীয় অংশে (১ করিন্থীয় ৭:১২-১৫) তিনি তার ব্যক্তিগত মতামত ও পরামর্শ প্রদান করেন।
  • প্রথম অংশে তিনি বলেন যে, গ্রীক ও রোমীয় সমাজের স্ত্রীরা বাসা থেকে চলে গেলে অথবা ঘর থেকে স্ত্রী বের করে দিলে, যদিও তা আইনী বিবাহবিচ্ছেদ হিসাবে দেখা হত, তবুও তা বিশ্বাসীদের জন্য নিষেধ। একজন বিশ্বাসীর দায়িত্ব হল, যতদূর সম্ভব গুরুত্বের সঙ্গে পুনর্মিলনের প্রচেষ্টা করা এবং পুনর্বিবাহ না করে বিপরীতে পুনর্মিলনের জন্য প্রস্তুত হওয়া। পৌল এখানে গ্রীক ও রোমীয় সংস্কৃতি ও পরিস্থিতির বিরুদ্ধে কথা বলেন, কারণ যিহূদী আইন অনুসারে ‘ঘর থেকে চলে যাওয়া’-র অর্থ এই নয় যে, বিবাহবিচ্ছেদ বৈধ হয়েছে।
  • যীশু ও পৌল উভয়েই শুধুমাত্র ৪টি গ্রহণযোগ্য কারণে বিবাহবিচ্ছেদ বৈধ হিসাবে অনুমোদিত করেন, কিন্তু “যে কোন কারণে” বিবাহবিচ্ছেদ অনুমোদিত করেন না।
  • দ্বিতীয় অংশে (১ করিন্থীয় ৭:১২-১৫) পদের যুক্তির ভিত্তিতে পৌল নিজের মত প্রকাশ করেন: বিবাহিত দম্পত্তির কোন একজন যীশুকে গ্রহণ করার মাধ্যমে বিশ্বাসী হলে, অপরজন অবিশ্বাসী থাকলেও বিবাহবিচ্ছেদ আবশ্যক নয়। কিন্তু ধর্মান্তরিত হওয়ায় অবিশ্বাসী সঙ্গী বিবাহ অগ্রাহ করলে বা বিবাহবিচ্ছেদ করতে চাইলে, এক্ষেত্রে বিবাহবিচ্ছেদ বৈধ হয়।
  • গ্রীক ও রোমীয়েরা পরিত্যাগের দ্বারা যেভাবে বিবাহবিচ্ছেদ করত, পৌল বিশ্বাসীদের সেরূপ করতে নিষেধ করেন, এমনকি অবিশ্বাসী স্বামী বা স্ত্রীর ক্ষেত্রেও নিষিদ্ধ। কিসের ভিত্তিতে পৌল এই নিষেধাজ্ঞা দেন? যীশু হিল্লেলের “যে কোন কারণে” বিবাহবিচ্ছেদ নিষেধ করেছেন, তা সমর্থন করে পৌল এই নিষেধাজ্ঞা দেন যে, দম্পত্তির মাত্র একজন ধর্মান্তরিত হলেও অবিশ্বাসী সঙ্গীকে পরিত্যাগ করা চলবে না। কিন্তু যদি অবিশ্বাসী সঙ্গী বিবাহবিচ্ছেদ করতে চায়, সেক্ষেত্রে প্রতিরোধ করা যায় না।
  • অবিশ্বাসী সঙ্গীর দ্বারা বিবাহবিচ্ছেদ-প্রাপ্ত বিশ্বাসীর কি পুনরায় বিবাহ করা অনুমোদিত? এক্ষেত্রে পৌলের সমর্থনের উত্তর হল: বিবাহবিচ্ছেদ-প্রাপ্ত বিশ্বাসী আর “বাঁধাবাঁধির মধ্যে” নেই। এর অর্থ কি আলাদা হওয়া যায়? পুর্নমিলন অগ্রাহ্য করা যায় এবং পুনরায় বিবাহ করা অনুমোদিত?
  • পৌলের এই উক্তির অর্থ এই: অবিশ্বাসী সঙ্গীর পরিত্যাগ করা বা বিবাহবিচ্ছেদ করা বিশ্বাসী ব্যক্তি পুনরায় যাকে ইচ্ছা বিবাহ করতে পারে, ১ করিন্থীয় ৭:৩৯ পদে যেমন বলা আছে “সে যাকে ইচ্ছা তাকে বিয়ে করতে পারে”। প্রকৃতপক্ষে, “যাকে ইচ্ছা করে তাকে বিয়ে করুক” উল্লিখিত এই উক্তি যিহূদী ত্যাগ-পত্রে পুনরায় বিবাহ করার অনুমতি বুঝায়।
  • “ঈশ্বর তো আমাদের শান্তিতে থাকবার জন্যই ডেকেছেন।” পৌলের এই উক্তি, যিহূদীদের ত্যাগ-পত্রের প্রচলিত উক্তির (শান্তি যেন হয়) সাথে মিল রয়েছে। যখন কোন বাস্তববাদী সমাধান প্রয়োজনীয় ছিল, তখন এই উক্তি ব্যবহৃত হত।
  • প্রকৃতপক্ষে, স্বামী চলে গেলে (যুদ্ধে বা দুর্যোগে নিখোঁজ হলে), তবে মোশির আইন-কানুন অনুসারে স্ত্রীর পুনর্বিবাহের অনুমোদন ছিল না। বিপরীতভাবে, স্ত্রী চলে গেলে বা নিখোঁজ হলে, তবে স্বামীর পুনর্বিবাহের অনুমোদন ছিল, কারণ বহুবিবাহ পুরুষদের ক্ষেত্রে অনুমোদিত ছিল। তাই স্ত্রীলোকদের জন্য এটি খুবই কঠিন অবস্থা সৃষ্টি হত, এমনকি এই সমস্যা আধুনিক যুগের যিহূদী নারীদেরও ভোগ করতে হয়। এই ধরণের নারীদের বলা হত ‘আগুনোৎ’ (agunot), এর অর্থ হল ‘শিঁকল-প্রাপ্ত নারী বা শিঁকলে আবদ্ধ নারী)। এছাড়াও যে সব নারীরা আদালতের সাহায্যে স্বামীকে ত্যাগ-পত্র লিখাতে বাধ্য করতে সক্ষম হয় না, এদেরকেও ‘শিঁকলে আবদ্ধ নারী’ বলা হয়।
  • এই ধরণের সমস্যার সমাধানে পৌলের মতামত হল এই: গ্রীক ও রোমীয় সমাজের মত একজন স্ত্রী পরিত্যাক্ত হলে, অথবা যিহূদী হলেও স্বামী ত্যাগ-পত্র লিখতে অস্বীকার করলে, তা প্রতিরোধের উপায় নেই বলে এই ধরণের নারীদের বৈধভাবে বিবাহবিচ্ছেদ-প্রাপ্ত নারী হিসাবে গণ্য করা উচিত এবং এমন নারীর পুনর্বিবাহের অনুমতি রয়েছে।
  • প্রকৃতপক্ষে, ঠিক কি কারণে একজন স্ত্রীকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে বিবাহবিচ্ছেদে বাধ্য করানো হয়, তা নিয়ে পৌল আলোচনা করতে ব্যস্ত নন। স্ত্রী পরিত্যাগের বিষয়ে পৌল বিশ্বাসীদের গ্রীক-রোমীয় সংস্কৃতি অনুসরণ করতে নিষেধ করেন, তবে একজন বিশ্বাসী স্ত্রীকে তার অবিশ্বাসী স্বামী জোর করে বিবাহবিচ্ছেদে বাধ্য করালে, পৌল তা আইনী বা বৈধ বিবাহবিচ্ছেদ হিসাবে গণ্য করতে অনুমোদন দেন এবং এক্ষেত্রে পুনর্বিবাহের অনুমতি রয়েছে।
১ করিন্থীয় ৭:১০-১৫ পরিত্যাগ করা বিবাহবিচ্ছেদের বৈধ উপায় নয়

“যাদের বিয়ে হয়েছে তাদের আমি এই আদেশ দিচ্ছি-অবশ্য আমি দিচ্ছি না, প্রভুই দিচ্ছেন-স্ত্রী যেন স্বামীর কাছ থেকে চলে না যায়। ১১ কিন্তু যদি সে চলেই যায় তবে আর বিয়ে না করুক কিম্বা স্বামীর সংগে আবার মিলিত হোক। স্বামীও তার স্ত্রীকে ত্যাগ না করুক।
১২ অন্য সবাইকে অবশ্য প্রভু বলছেন না কিন্তু আমি বলছি, যদি কোন ভাইয়ের খ্রীষ্টে অবিশ্বাসী স্ত্রী থাকে আর সেই স্ত্রী তার সংগে থাকতে রাজী থাকে, তবে সেই স্বামী যেন তাকে ত্যাগ না করে। ১৩ আবার যদি কোন স্ত্রীলোকের খ্রীষ্টে অবিশ্বাসী স্বামী থাকে আর সেই স্বামী তার সংগে থাকতে রাজী থাকে, তবে সেই স্বামীকে যেন সে ত্যাগ না করে; ১৪ কারণ স্ত্রীর মধ্য দিয়ে সেই অবিশ্বাসী স্বামীকে আর স্বামীর মধ্য দিয়ে সেই অবিশ্বাসী স্ত্রীকে ঈশ্বর বিশেষ চোখে দেখেন। তা না হলে তোমাদের ছেলেমেয়েরা তো অশুচি হত; কিন্তু আসলে ঈশ্বর তাদের বিশেষ চোখে দেখেন। ১৫ কিন্তু যদি সেই অবিশ্বাসী স্বামী বা স্ত্রী চলে যেতে চায় তবে সে চলে যাক। এই রকম অবস্থায় সেই বিশ্বাসী ভাই বা বোন কোন বাঁধাবাঁধির মধ্যে থাকে না। ঈশ্বর তো আমাদের শান্তিতে থাকবার জন্যই ডেকেছেন।”

  • এই শাস্ত্রাংশ দু’ভাগ করা: প্রথম অংশে (১ করিন্থীয় ৭:১০-১১) যীশুর শিক্ষার ভিত্তিতে বিবাহবিচ্ছেদের সম্বন্ধে পৌল সরাসরি আদেশ দেন এবং দ্বিতীয় অংশে (১ করিন্থীয় ৭:১২-১৫) তিনি তার ব্যক্তিগত মতামত ও পরামর্শ প্রদান করেন।
  • প্রথম অংশে তিনি বলেন যে, গ্রীক ও রোমীয় সমাজের স্ত্রীরা বাসা থেকে চলে গেলে অথবা ঘর থেকে স্ত্রী বের করে দিলে, যদিও তা আইনী বিবাহবিচ্ছেদ হিসাবে দেখা হত, তবুও তা বিশ্বাসীদের জন্য নিষেধ। একজন বিশ্বাসীর দায়িত্ব হল, যতদূর সম্ভব গুরুত্বের সঙ্গে পুনর্মিলনের প্রচেষ্টা করা এবং পুনর্বিবাহ না করে বিপরীতে পুনর্মিলনের জন্য প্রস্তুত হওয়া। পৌল এখানে গ্রীক ও রোমীয় সংস্কৃতি ও পরিস্থিতির বিরুদ্ধে কথা বলেন, কারণ যিহূদী আইন অনুসারে ‘ঘর থেকে চলে যাওয়া’-র অর্থ এই নয় যে, বিবাহবিচ্ছেদ বৈধ হয়েছে।
  • যীশু ও পৌল উভয়েই শুধুমাত্র ৪টি গ্রহণযোগ্য কারণে বিবাহবিচ্ছেদ বৈধ হিসাবে অনুমোদিত করেন, কিন্তু “যে কোন কারণে” বিবাহবিচ্ছেদ অনুমোদিত করেন না।
  • দ্বিতীয় অংশে (১ করিন্থীয় ৭:১২-১৫) পদের যুক্তির ভিত্তিতে পৌল নিজের মত প্রকাশ করেন: বিবাহিত দম্পত্তির কোন একজন যীশুকে গ্রহণ করার মাধ্যমে বিশ্বাসী হলে, অপরজন অবিশ্বাসী থাকলেও বিবাহবিচ্ছেদ আবশ্যক নয়। কিন্তু ধর্মান্তরিত হওয়ায় অবিশ্বাসী সঙ্গী বিবাহ অগ্রাহ করলে বা বিবাহবিচ্ছেদ করতে চাইলে, এক্ষেত্রে বিবাহবিচ্ছেদ বৈধ হয়।
  • গ্রীক ও রোমীয়েরা পরিত্যাগের দ্বারা যেভাবে বিবাহবিচ্ছেদ করত, পৌল বিশ্বাসীদের সেরূপ করতে নিষেধ করেন, এমনকি অবিশ্বাসী স্বামী বা স্ত্রীর ক্ষেত্রেও নিষিদ্ধ। কিসের ভিত্তিতে পৌল এই নিষেধাজ্ঞা দেন? যীশু হিল্লেলের “যে কোন কারণে” বিবাহবিচ্ছেদ নিষেধ করেছেন, তা সমর্থন করে পৌল এই নিষেধাজ্ঞা দেন যে, দম্পত্তির মাত্র একজন ধর্মান্তরিত হলেও অবিশ্বাসী সঙ্গীকে পরিত্যাগ করা চলবে না। কিন্তু যদি অবিশ্বাসী সঙ্গী বিবাহবিচ্ছেদ করতে চায়, সেক্ষেত্রে প্রতিরোধ করা যায় না।
  • অবিশ্বাসী সঙ্গীর দ্বারা বিবাহবিচ্ছেদ-প্রাপ্ত বিশ্বাসীর কি পুনরায় বিবাহ করা অনুমোদিত? এক্ষেত্রে পৌলের সমর্থনের উত্তর হল: বিবাহবিচ্ছেদ-প্রাপ্ত বিশ্বাসী আর “বাঁধাবাঁধির মধ্যে” নেই। এর অর্থ কি আলাদা হওয়া যায়? পুর্নমিলন অগ্রাহ্য করা যায় এবং পুনরায় বিবাহ করা অনুমোদিত?
  • পৌলের এই উক্তির অর্থ এই: অবিশ্বাসী সঙ্গীর পরিত্যাগ করা বা বিবাহবিচ্ছেদ করা বিশ্বাসী ব্যক্তি পুনরায় যাকে ইচ্ছা বিবাহ করতে পারে, ১ করিন্থীয় ৭:৩৯ পদে যেমন বলা আছে “সে যাকে ইচ্ছা তাকে বিয়ে করতে পারে”। প্রকৃতপক্ষে, “যাকে ইচ্ছা করে তাকে বিয়ে করুক” উল্লিখিত এই উক্তি যিহূদী ত্যাগ-পত্রে পুনরায় বিবাহ করার অনুমতি বুঝায়।
  • “ঈশ্বর তো আমাদের শান্তিতে থাকবার জন্যই ডেকেছেন।” পৌলের এই উক্তি, যিহূদীদের ত্যাগ-পত্রের প্রচলিত উক্তির (শান্তি যেন হয়) সাথে মিল রয়েছে। যখন কোন বাস্তববাদী সমাধান প্রয়োজনীয় ছিল, তখন এই উক্তি ব্যবহৃত হত।
  • প্রকৃতপক্ষে, স্বামী চলে গেলে (যুদ্ধে বা দুর্যোগে নিখোঁজ হলে), তবে মোশির আইন-কানুন অনুসারে স্ত্রীর পুনর্বিবাহের অনুমোদন ছিল না। বিপরীতভাবে, স্ত্রী চলে গেলে বা নিখোঁজ হলে, তবে স্বামীর পুনর্বিবাহের অনুমোদন ছিল, কারণ বহুবিবাহ পুরুষদের ক্ষেত্রে অনুমোদিত ছিল। তাই স্ত্রীলোকদের জন্য এটি খুবই কঠিন অবস্থা সৃষ্টি হত, এমনকি এই সমস্যা আধুনিক যুগের যিহূদী নারীদেরও ভোগ করতে হয়। এই ধরণের নারীদের বলা হত ‘আগুনোৎ’ (agunot), এর অর্থ হল ‘শিঁকল-প্রাপ্ত নারী বা শিঁকলে আবদ্ধ নারী)। এছাড়াও যে সব নারীরা আদালতের সাহায্যে স্বামীকে ত্যাগ-পত্র লিখাতে বাধ্য করতে সক্ষম হয় না, এদেরকেও ‘শিঁকলে আবদ্ধ নারী’ বলা হয়।
  • এই ধরণের সমস্যার সমাধানে পৌলের মতামত হল এই: গ্রীক ও রোমীয় সমাজের মত একজন স্ত্রী পরিত্যাক্ত হলে, অথবা যিহূদী হলেও স্বামী ত্যাগ-পত্র লিখতে অস্বীকার করলে, তা প্রতিরোধের উপায় নেই বলে এই ধরণের নারীদের বৈধভাবে বিবাহবিচ্ছেদ-প্রাপ্ত নারী হিসাবে গণ্য করা উচিত এবং এমন নারীর পুনর্বিবাহের অনুমতি রয়েছে।
  • প্রকৃতপক্ষে, ঠিক কি কারণে একজন স্ত্রীকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে বিবাহবিচ্ছেদে বাধ্য করানো হয়, তা নিয়ে পৌল আলোচনা করতে ব্যস্ত নন। স্ত্রী পরিত্যাগের বিষয়ে পৌল বিশ্বাসীদের গ্রীক-রোমীয় সংস্কৃতি অনুসরণ করতে নিষেধ করেন, তবে একজন বিশ্বাসী স্ত্রীকে তার অবিশ্বাসী স্বামী জোর করে বিবাহবিচ্ছেদে বাধ্য করালে, পৌল তা আইনী বা বৈধ বিবাহবিচ্ছেদ হিসাবে গণ্য করতে অনুমোদন দেন এবং এক্ষেত্রে পুনর্বিবাহের অনুমতি রয়েছে।
১ করিন্থীয় ৭:৩৯-৪০ বিধবাদের উদ্দেশ্য পুনর্বিবাহ সম্বন্ধে

“স্বামী যতদিন বেঁচে থাকে ততদিনই স্ত্রী তার কাছে বাঁধা থাকে। কিন্তু যদি স্বামী মারা যায় তবে সে যাকে ইচ্ছা তাকে বিয়ে করতে পারে, অবশ্য সেই লোক যেন প্রভুর হয়। ৪০ কিন্তু আমার মতে সে যেমন আছে যদি তেমনই থাকে তবে সে আরও সুখী হয়। আমার মনে হয় যে, আমি ঈশ্বরের আত্মার মধ্য দিয়েই এই কথা বলছি।”

  • এখানে পৌল বিধবাদের উদ্দেশ্যে বলেন (অনেকে মনে করে যে, উল্লিখিত পদটি হল সেই সব বিধবাদের উদ্দেশ্যে, যাদের পুনর্বিবাহ ঠিক হয়েছে)।
  • মোশির আইন-কানুন অনুসারে, এই ধরণের বিধবাদের মৃত স্বামীর ভাইকে বিয়ে করা উচিত যেন উত্তরাধিকার বহন করার জন্য পুত্র সন্তানের জন্ম হয় (Levirate marriage, দ্বিতীয় বিবরণ ২৫:৫-১০)। এই পদ্ধতি নিশ্চিত করে যে, পারিবারিক উত্তরাধিকার রক্ষার জন্য পরিবারে সব সময় পুরুষ লোক থাকবে, যার কাছে জুবল বছরে জমি ফেরত দেওয়া সম্ভব হবে। যিহূদীরা যখন বাবিলের নির্বাসন থেকে ফিরে আসে, তখন থেকে এই আইনের গুরুত্ব কমে যায়, কারণ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জমি আর উত্তরাধিকার-সূত্রে ফেরত দেওয়া হয়নি। এছাড়াও অযিহূদী বিশ্বাসীদের জন্য এই আইনের কোন প্রয়োগ ছিল না।
  • সম্ভবত, একারণে পৌল পুনর্বিবাহের ক্ষেত্রে বিধবাদের (এবং বিপত্নীকদের) মোশির আইনের মত মৃত স্বামীর ভাইকে বিবাহের জন্য আদেশ দেন না। অর্থাৎ, বিধবা বা বিপত্নীক পুর্নবিবাহের ক্ষেত্রে “যাকে ইচ্ছা তাকে বিয়ে করতে পারে”। পৌলের এই উক্তি একইভাবে বিভিন্ন যিহূদী ত্যাগ-পত্রে পাওয়া যায় এবং যিহূদীদের মিশ্নাতে (প্রায় ২০০ খ্রীষ্টাব্দে লিখিত, যিহূদী রব্বীদের আইন-কানুনের ব্যাখ্যা অনুসারে) এই উক্তিটি বিবাহবিচ্ছেদের দলিলে আদর্শ হিসাবে উল্লিখিত। পৌল মাত্র একটি শর্ত রাখেন, বিধবা বা বিপত্নীক পুর্নবিবাহ করলে তা যেন “প্রভুর লোক”-এর সাথে হয়, অর্থাৎ একজন বিশ্বাসীর সাথে হয়।
  • পৌলের যুক্তির সারাংশ হল: একজন বিবাহবিচ্ছেদ-প্রাপ্ত ব্যক্তির যে অধিকার রয়েছে, বিধবা ও বিপত্নীকেরও একই অধিকার রয়েছে। অর্থাৎ, বিবাহবিচ্ছেদ-প্রাপ্ত ব্যক্তির যেমন বিশ্বাসী যে কোন ব্যক্তিকে পুর্নবিবাহ করার অনুমোদন রয়েছে, ঠিক তেমনি বিধবা ও বিপত্নীকেরও বিশ্বাসী যে কোন ব্যক্তিকে পুর্নবিবাহ করার অনুমোদন রয়েছে। পরবর্তীতে আশি (Ashi) নামক একজন যিহূদী রব্বী পৌলের সাথে একমত হয়ে বলেন যে, মৃত স্বামীর ভাই ছাড়াও বিশ্বাসী যে কোন ব্যক্তিকে পুর্নবিবাহ করার অধিকার বিধবার রয়েছে।
রোমীয় ৭:১-৪ রূপক: আইনের অধীনে বা খ্রীষ্টের অধীনে

“ভাইয়েরা, তোমরা তো আইন-কানুন জান। তোমরা কি জান না যে, যতদিন মানুষ জীবিত থাকে ততদিনই আইন-কানুনের দাবি তার উপরে থাকে? ২ যতদিন স্বামী বেঁচে থাকে ততদিনই স্ত্রী আইন দ্বারা তার সংগে বাঁধা থাকে। কিন্তু স্বামী মারা যাবার পর সেই আইনের বাঁধন থেকে স্ত্রী মুক্ত হয়। ৩ সেইজন্য স্বামী বেঁচে থাকতে সেই স্ত্রী যদি অন্য কাউকে বিয়ে করে তবে তাকে ব্যভিচারিণী বলা হয়। কিন্তু যদি তার স্বামী মারা যায় তবে সে সেই আইনের বাঁধন থেকে মুক্ত হয়। আর তখন যদি সে অন্য কাউকে বিয়ে করে তবে সে ব্যভিচারিণী হয় না। ৪ ঠিক সেইভাবে আমার ভাইয়েরা, খ্রীষ্টের দেহের মধ্য দিয়ে মোশির আইন-কানুনের দাবি-দাওয়ার কাছে তোমরাও মরেছ। তার ফলে যাঁকে মৃত্যু থেকে জীবিত করা হয়েছে তোমরা সেই যীশু খ্রীষ্টেরই হয়েছ, যেন ঈশ্বরের জন্য তোমাদের জীবন ফলবান হয়ে ওঠে।”

  • পৌল বলেন যে, একজন বিধবার (বা বিপত্নীক) অবশ্যই পুনর্বিবাহ করার অনুমোদন রয়েছে। যদিও বিষয়টি পৌল এখানে উপমা হিসাবে বলেন, তবুও তা থেকে পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় যে, এ বিষয়ে সবাই একমত ছিল (যদিও কেউ কেউ শর্ত রাখত যে, মৃত স্বামীর ভাইকে বিয়ে করতে হয়)।
  • এই পদগুলোর অর্থ এই যে, বিবাহিত সঙ্গীর মৃত্যু ছাড়া পুনরায় বিবাহ নিষেধ, অর্থাৎ বিবাহবিচ্ছেদের জন্য কোনো গ্রহণযোগ্য কারণ নেই? প্রকৃতপক্ষে, যীশু অবশ্যই ব্যভিচার এবং সম্ভবত মোশির আইন-কানুন থেকে আসা ৪টি গ্রহণযোগ্য কারণ (যাত্রা ২১:১০-১১) বিবাহবিচ্ছেদের উপযুক্ত কারণ হিসাবে মানেন।
  • পৌলের উপমার অর্থ তাহলে কি? পৌল বুঝাতে চান যে, বিশ্বাসী হিসাবে খ্রীষ্টের সাথে যুক্ত বলে আমরা যীশুর মৃত্যুর অংশীদার হয়েছি, তাই খ্রীষ্টের সাথে যুক্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করায় আমরা আইনের দাবির কাছে মৃত্যুবরণ করি (একজন মৃতকে আর বিচার করা হয় না, তাকে শাস্তিও দেওয়া হয় না)। অর্থাৎ আইন-কানুনের সাথে আমাদের বিবাহিক জীবন আইন-কানুনের বৈধতা অনুসারে শেষ হয়েছে, তাই এখন খ্রীষ্টকে বিবাহ করার জন্য আমরা মুক্ত ও স্বাধীন।
  • সারাংশে বলা যায় যে, বিবাহবিচ্ছেদ সম্বন্ধীয় মোশির আইন-কানুনের ৪টি গ্রহণযোগ্য কারণ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বৈধ হিসাবে মান্য করা হত। তাই মোশি ও যীশুর শিক্ষার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, এমন কোন কিছু পৌলও এখানে বলেন না। একটি গ্রহণযোগ্য কারণ উল্লেখ করলে প্রত্যেকবার পুনরায় সব গ্রহণযোগ্য কারণগুলো উল্লেখ করা হয়, এমন নয়। এখানে পুনর্বিবাহের গ্রহণযোগ্য কারণ হিসাবে মৃত্যু উল্লিখিত, এক্ষেত্রে আরও কারণ থাকতে পারে।
১ তীমথিয় ৩:২, তীত ১:৫-৬ এক স্ত্রীর স্বামী

“পরিচালককে সেইজন্য এমন হতে হবে যেন কেউ তাঁকে দোষ দিতে না পারে। তাঁর মাত্র একজন স্ত্রী থাকবে। তিনি নিজেকে দমনে রাখবেন “
“মণ্ডলীর প্রধান নেতাকে এমন হতে হবে … তাঁর মাত্র একজনই স্ত্রী থাকবে।”

১ তীমথিয় ৫:৯ এক স্ত্রীর স্বামী

“বিধবাদের নামের তালিকায় কোন বিধবার নাম যোগ করবার আগে দেখতে হবে যে, তার বয়স ষাট বছরের কম নয় এবং সে স্বামীর প্রতি বিশ্বস্ত ছিল”

  • সাধারণ বাংলা অনুবাদে “তার মাত্র একজন স্ত্রী থাকবে”, কেরীতে “এক স্ত্রীর স্বামী”, বা “স্বামীর প্রতি বিশ্বস্ত ছিল”, এর অর্থ বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, যেমন:
    • ১) মণ্ডলীর নেতাদের বিবাহিত হতেই হবে। এই ব্যাখ্যা যদি ঠিক হয়, তবে যীশু (!), পৌল এবং যে কোন বিপত্নীককে মণ্ডলীর নেতৃত্ব থেকে বাদ দিতে হবে। কিন্তু পৌল বিবাহ না করার পরামর্শ দিয়েছেন (১ করিন্থীয় ৭), যেন বিশ্বাসীরা “দেহে আর অন্তরে প্রভুর হতে পারে” বা ইংরেজিতে “প্রভুর কাজে” ব্যস্ত হতে পারে। দেখা যায়, ব্যাখ্যাটি অতি সরু।
    • ২) মণ্ডলীর নেতা হিসাবে শুধুমাত্র একবিবাহের ব্যক্তির নেতৃত্বের অনুমোদন রয়েছে, এই ব্যাখ্যা এই পদের জন্য অর্থপূর্ণ। কিন্তু এছাড়া ১ তীম ৫:৯ পদে নারীদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত শব্দ একই অর্থ বহন করে, তবে নারীদের জন্য বহুবিবাহ কখনও অনুমোদিত ছিল না। তাই এই ব্যাখ্যা সব ক্ষেত্রে মানায় না।
    • ৩) মণ্ডলীর নেতাদের যৌন ক্ষেত্রে বিশ্বস্ত এবং আদর্শ ব্যক্তি হতে হবে, ব্যভিচার এবং বহুবিবাহ উভয় চলবে না।
ইফিষীয় ৫:২৮-২৯ ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য‌‌‌‌

“স্বামী যেমন নিজের দেহকে ভালবাসে ঠিক সেইভাবে নিজের স্ত্রীকেও তার ভালবাসা উচিত। যে নিজের স্ত্রীকে ভালবাসে সে নিজেকেই ভালবাসে। ২৯ কেউ তো কখনও নিজের দেহকে ঘৃণা করে না, বরং সে তার দেহের ভরণ-পোষণ ও যত্ন করে। ঠিক সেইভাবে খ্রীষ্টও তাঁর মণ্ডলীর যত্ন করেন।”

  • পৌল এখানে যাত্রা ২১:১০-১১ পদ যেমন বলে দাবি করেন যে, স্বামী ও স্ত্রীর উভয়ের পরস্পরের প্রতি ‘আবেগীয় বা মানসিক এবং বস্তুগত উভয় ক্ষেত্রে’ দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। পৌল এখানে নির্দিষ্টভাবে স্বামীদের উদ্দেশ্যে তা বলেন, যদিও আইন-কানুনে তা দু’দিকে নির্দেশিত ‌‌(স্বামীর খাদ্য ও বস্ত্রের যোগান নিশ্চিত করতে হবে এবং স্বামীর যোগান থেকে স্ত্রীর খাবার ও পোশাক প্রস্তুত করতে হবে)।

মণ্ডলীর ইতিহাসে বিবাহবিচ্ছেদ ও পুনর্বিবাহ

  • ৭০ খ্রীষ্টাব্দে রোমীয়দের দ্বারা যিহূদা ও যিরূশালেম ধ্বংসের ফলে যিহূদীরা চারিদিকে ছড়িয়ে গিয়ে ভিন্ন সংস্কৃতির লোকদের মধ্যে বসবাস করতে থাকে। একারণে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় ‘বিবাহবিচ্ছেদ ও পুর্নবিবাহ’ বিষয়ক মোশির আইন-কানুনের মৌলিক শিক্ষা ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে। এর সাথে পুরাতন নিয়ম সম্বন্ধেও খ্রিষ্টানদের জ্ঞান কমতে থাকে।
‘বিবাহবিচ্ছেদ ও পুনর্বিবাহ’ বিষয়ে ক্যাথলিক মণ্ডলীর আদিপিতাদের কথা
  • রোম শহরের হের্মাস (Hermas, ১০০-১৫০ খ্রীঃ) বলেন যে, স্ত্রীর অব্যাহত ব্যভিচার জেনেও ব্যভিচারী স্ত্রীকে গ্রহণ করলে, স্ত্রীর ব্যভিচারের সহদোষী হলেন স্বামী। অনুতাপের জন্য মাত্র একবার সুযোগ দেওয়া উচিত। বাপ্তিস্মের পর যে কোন পাপ করলে, তা আর ক্ষমা করা হবে না। বিবাহবিচ্ছেদ-প্রাপ্ত ব্যক্তির অন্য কাউকে পুনর্বিবাহ করা উচিত নয়, কারণ পূর্ব-বিবাহ পুনর্মিলনের সম্ভাবনা রয়েছে।
  • রোম শহরের শহীদ মার্টীর (Justin Martyr, ১৩৯ খ্রীঃ) হের্মাসের মত শিক্ষা দিতেন। তার মতে পুনরায় বিবাহ করা পাপ। তিনি একটি ঘটনা উল্লেখ করেন, যেখানে একজন স্ত্রীর প্রতি তার স্বামীর বার বার নির্যাতন ও অবিশ্বস্ততার বিষয়ে মণ্ডলী পরামর্শ দিতে অনিশ্চয়তায় ও দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিল, অর্থাৎ এমন স্বামীকে ত্যাগ করা উচিত হবে কি না।
  • এথেন্স শহরের আথেনাগরাস্ (Athenagoras, ১৭৭ খ্রীঃ) গর্বের সাথে বলতেন যে, অনেক বিশ্বাসীরা বিবাহের ইচ্ছা বাদ দিয়েছে এবং অন্যান্যরা মাত্র সন্তান জন্মদানের জন্য বিবাহ করে। তিনি বিধবাদের জন্য পুনর্বিবাহ নিষিদ্ধ করেন, সম্ভবত আদি ২:২৪ পদে ‘দু’জন একদেহ’’ এই বিষয়ের কারণে।
  • আন্তিয়খিয়া শহরের থিয়োফিলাস (Theophilus, ১৭৮-১৮৮ খ্রীঃ) মনে করেন যে, শুধুমাত্র ব্যভিচারের ফলে বিবাহবিচ্ছেদ অনুমোদিত ও বৈধ।
  • আলেকজান্দিয়া শহরের ক্লীমেন্ট্ (Clement of Rome, ১৯২ খ্রীঃ) বলতেন যে‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌, সন্তান জন্মদানের জন্য বিবাহ প্রয়োজন,‌ কিন্তু বৈবাহিক বিষয়ে আনন্দভোগ সীমিত হওয়া উচিত। ব্যভিচারের শাস্তি কঠোর হতে হবে। পুনর্বিবাহ উচিত নয়, যেন পুনর্মিলনের সুযোগ থাকে।
  • তের্তুলিয়ান (Tertullian, ১৯৩-২২০ খ্রীঃ) তার শিক্ষা ধীরে ধীরে আরো কঠোর হয়ে গেল। প্রথমদিকে বিধবা বা বিপত্নীকদের পুনর্বিবাহের অনুমোদন দিলেও তা নিরুৎসাহিত করতেন। পরবর্তীতে তিনি পুনর্বিবাহ পাপ হিসাবে চিহ্ণিত করেন।
  • ওরিগেন (Origen, ১৮৫-২৫৪ খ্রীঃ) বলতেন যে, বিধবা বা বিপত্নীক পুনর্বিবাহ করতে পারে। তিনি ব্যভিচার বিবাহবিচ্ছেদের একমাত্র গ্রহণযোগ্য কারণ হিসাবে মানতেন। তার মতে, বিবাহবিচ্ছেদ সম্বন্ধীয় মোশি তার নিজস্ব মতবাদ দিয়েছিলেন, একারণে তা যীশুর শিক্ষার সাথে মিলে না। ঈশ্বর হলেন বিবাহবিচ্ছেদ-প্রাপ্ত স্বামী, পুরাতন নিয়মে ব্যবহৃত এই রূপক তিনি এভাবে ব্যাখ্যা করতেন: যখন যিরূশালেমের যিহূদীরা বারাব্বাকে চেয়ে যীশুকে পরিত্যাগ করেন তখন তারা ব্যভিচার করে। যীশুর সাথে মণ্ডলীর বিবাহ হল ‘পুনর্বিবাহ’। অর্থাৎ ওরিগেনের মতে, বিবাহবিচ্ছেদের পরে পুনর্বিবাহ করা অবৈধ, তবে বিবাহিত সঙ্গীর মৃত্যুর পর পুনর্বিবাহ করা অনুমোদিত ও বৈধ। বিবাহবিচ্ছেদের একমাত্র গ্রহণযোগ্য কারণ হল ‘ব্যভিচার’।
  • ইরেন্যায়াস্ (Irenaeus) ও প্টলেম্যায়াস্ (Ptolemaeus, দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষ দিকে) বলতেন যে, মোশি আইন-কানুনে তার নিজস্ব মতামত জানান, একারণে তা যীশুর শিক্ষার সাথে মিলে না।
  • আমব্রোসিয়াস্টার (Ambrosiaster) বলতেন যে, অবিশ্বাসী স্বামী বা স্ত্রী যদি বিশ্বাসী স্বামী বা স্ত্রীকে পরিত্যাগ করে, তবে পুনর্বিবাহ অনুমোদিত। বিশ্বাসী যদি অবিশ্বাসীকে বিবাহ করে, তবে তা অবৈধ।
  • জেরোম্ (Jerome) ও খ্রীসোস্টম (Chrysostom, ৩৫০-৪১০ খ্রীঃ) বলতেন যে, একমাত্র মৃত্যু ছাড়া বিবাহবিচ্ছেদের কোন বৈধ বা গ্রহণযোগ্য কারণ নেই। এমন কি, একজন নির্যাতিত স্বামীর দ্বারা পরিত্যাক্ত এবং পরিবারের দ্বারা পুনর্বিবাহে বাধ্য করা স্ত্রীলোককে ‘প্রভুর ভোজ’ গ্রহণ করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে হবে।
  • সাইপ্রাসের এপিফানিয়াস্ (Epiphanius, প্রায় ৪০০ খ্রীঃ) বলতেন যে, শুধুমাত্র ব্যভিচারের দোষে বিবাহবিচ্ছেদ হলে পুনর্বিবাহ করা বৈধ। এটিকে তিনি ‘তুলনামূলক ছোট পাপ’ বলতেন।
  • হিপ্পো শহরের অগাস্টীন (Augustin of Hippo, ৪১৯ খ্রীঃ) বলতেন যে, ব্যভিচার হল বিবাহবিচ্ছেদের একমাত্র গ্রহণযোগ্য কারণ এবং পুনর্বিবাহ করা নিষিদ্ধ। বিবাহ পবিত্র বলে (একটি সাক্র্যামেন্ট, sacrament), শুধুমাত্র মৃত্যু দ্বারা বিবাহ ভাঙ্গা যায়। যদিও এই বিষয়ে তার মতামত সম্বন্ধে তিনি দ্বিধা প্রকাশ করেছিলেন, তবুও পরবর্তীতে তা মণ্ডলীর নিয়ম হয়ে উঠেছিল।
  • থোমাস আকুয়াইনাস (Thomas Aquinas, ১৩শ খ্রীঃ) আদিপিতা আগষ্টীনের উপর ভিত্তি করে রোমান ক্যাথলিক মণ্ডলীর নিয়ম স্থাপন করেন: বিবাহ একটি পবিত্র বিষয়, ফলে এটি কখনও ভাঙ্গা যায় না। নতুন নিয়মে উল্লিখিত বিবাহবিচ্ছেদ তিনি ‘আলাদা হওয়া বা বিচ্ছিন্নতা’ হিসাবে বোঝেন, কিন্তু প্রকৃত বিবাহবিচ্ছেদ বা বিবাহের সমাপ্তি হিসাবে নয়। বিবাহবিচ্ছেদ বা পরিত্যাক্ত হলে পুনর্বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল।
  • ক্যাথলিক মণ্ডলীর মতবাদের ভিত্তিতে বিবাহ আইন যত কঠোর হতে থাকে, বিবাহ বাতিল করার (annulment) গ্রহণযোগ্য কারণের তালিকা আরও দীর্ঘ হতে থাকে।
  • ক্যাথলিক মণ্ডলীর মতবাদ অনুসারে, বিবাহবিচ্ছেদ শুধুমাত্র ব্যভিচার এবং অবিশ্বাসীর দ্বারা পরিত্যাগের কারণে অনুমোদিত। শুধুমাত্র পূর্বের দাম্পত্য জীবনের সঙ্গী মারা গেলে পুনর্বিবাহের অনুমোদন রয়েছে। বিবাহ করার চেয়ে না করা ভাল, একারণে এই কঠোর ব্যাখ্যা অনেক বেশি সমর্থন পেয়েছিল।
  • বাংলাদেশেও দেখা যায় যে, ক্যাথলিক মণ্ডলীতে বিবাহবিচ্ছেদ নিষিদ্ধ, একারণে পুরুষেরা স্ত্রী পরিত্যাগ করে নতুন জায়গায় গিয়ে পুনর্বিবাহ করে পরিবার স্থাপন করে, এর ফলে পরিবারে বিভিন্ন সমস্যা দেখা যায়।
পুনঃসংস্কার (প্রায় ১৫০০ খ্রীষ্টাব্দে)
  • পুনঃসংস্কারের সাথে বাইবেলের পুনরাবিষ্কার ও গুরুত্ব দান এবং মণ্ডলীর ঐতিহ্য ও প্রচলিত মতবাদের পুনর্মূল্যায়ন ঘটে। ধীরে ধীরে বিবাহবিচ্ছেদ ও পুনর্বিবাহ নিয়ে প্রচলিত মতবাদও নতুন করে মূল্যায়ন করা হয়। বিবাহবিচ্ছেদ ও পুনর্বিবাহ সম্বন্ধীয় ওরিগেনের সন্দেহগুলো নতুনভাবে পরীক্ষা ও মূল্যায়ন করা হয়, যদিও তখনও পুরাতন নিয়মের ভিত্তি এখনও পাওয়া যায় নি।
  • সেই সময়ে নতুন নিয়ম গ্রীক ভাষায় পাওয়া যায় বলে এরাসমুস্ (Erasmus) বলতেন যে, বিবাহ একটি পবিত্র বন্ধন (একটি সাক্র্যামেন্ট, sacrament), যার কারণে বিবাহ ভাঙ্গা কখনও ঠিক নয়, ক্যাথলিক এই মতবাদ ল্যাটিন ভাষার ভুল্গাটা বাইবেলের একটি বিশেষ অনুবাদের কারণে তৈরি হয়েছিল। তিনি বলেন যে, যীশু ‘ব্যভিচারের কারণে বিবাহবিচ্ছেদ ও পুনর্বিবাহ অনুমোদিত’ করেন এবং পৌল পরিত্যাক্ত বিশ্বাসীর ক্ষেত্রে বিবাহবিচ্ছেদ ও পুনর্বিবাহ অনুমোদিত করেছেন।
  • মার্টিন লুথার বলতেন যে, বিবাহ কোনো সাক্র্যামেন্ট নয়। মৃত্যু ছাড়াও বিবাহ ভাঙ্গতে পারে, কারণ একজন ব্যভিচারী আত্মিক ক্ষেত্রে মৃত, একারণে ব্যভিচার বিবাহবিচ্ছেদের একটি বৈধ কারণ। তিনি ‘ব্যভিচার এবং অবিশ্বাসী দ্বারা পরিত্যাগের কারণে পুনর্বিবাহের অনুমতি দেন। এছাড়া ‘শারীরিক সমস্যা বা অক্ষমতা এবং বার বার যৌন-সম্পর্ক প্রত্যাখ্যান বিবাহবিচ্ছেদের কারণ হিসাবে অনুমোদিত করেন এবং এক্ষেত্রে তিনি পুনর্বিবাহের অনুমোদনও দেন। আবার, স্বামী অপহরণ হলে এবং তার প্রত্যাবর্তনের বা ফিরে আসার আশা না থাকলে, স্ত্রীর পুনর্বিবাহের অনুমোদন রয়েছে।
  • সুইংলী ও বুল্লিঙ্গার ব্যভিচার এবং অন্যান্য যে কোনো কারণে বিবাহবিচ্ছেদ অনুমোদিত করেন, এই কারণে যে, যীশু অন্য কোন কারণে বিবাহবিচ্ছেদ নিষেধ করেন নি।
  • ক্যাল্ভিন ও বেজা শুধুমাত্র ব্য‌ভিচার এবং অবিশ্বাসীর দ্বারা পরিত্যাগের কারণে বিবাহবিচ্ছেদ এবং পুনর্বিবাহ অনুমোদিত করেন। পরবর্তীতে তারা আরও ৩টি কারণে বিবাহবিচ্ছেদ ও পুনর্বিবাহের অনুমোদন দেন, তা হল: যৌন-অক্ষমতা, ধর্মীয় ক্ষেত্রে চরম অমিল এবং বিশ্বাসী দ্বারা পরিত্যাগ।
  • উইলিয়াম টিন্ডেল লুথারের মত বলতেন যে, বিবাহ কোনো সাক্র্যামেন্ট নয়। এছাড়া তিনি ব্যভিচার এবং পরিত্যাগের কারণে বিবাহবিচ্ছেদ ও পুনর্বিবাহ অনুমোদিত করেন। তিনি ইংল্যান্ডের রাজা হেনরি-৮-কে তার আরাগনের স্ত্রী ক্যাথারিনার সাথে বিবাহবিচ্ছেদের বিরোধীতা করেন। বিপরীতে, থোমাস্ ক্রান্মের তা সমর্থন করেন, একারণে ১৫৩৩ খ্রীষ্টাব্দে রাজা হেনরী-৮ তাকে ক্যান্টারবেরির অধক্ষ্য (ইংল্যান্ডের প্রটেস্টেন্ট মণ্ডলীর কেন্দ্র) হিসাবে নিযুক্ত করেন।
  • থোমাস্ ক্রান্মের ক্যাথলিক পোপ স্বীকৃত বিবাহ বাতিল করার নিয়ম (annulment) অস্বীকার করেন। তিনি যে সব কারণে বিবাহবিচ্ছেদ ও পুনর্বিবাহ অনুমোদিত করেন, তা হল: ব্যভিচার, পরিত্যাগ, দীর্ঘদিনের অনুপস্থিতি, মর্মান্তিক ঘৃণা ও হিংস্রতা। রাজা এডওয়ার্ড এবং রানী এলিজাবেথ-১-এর রাজত্বের সময়ে বিবাহবিচ্ছেদ ও পুনর্বিবাহ সম্বন্ধীয় তার নিয়মের অনুমোদন কার্যকর ও বিস্তার করা হয় নি। তাই অ্যাংলিকান মণ্ডলী এই দু’জন শাসকদের সময়ে ক্যাথলিক পোপ স্বীকৃত বিবাহ বাতিল করার নিয়ম অনুসারে চলতে থাকে।
  • আধুনিক ইংল্যান্ড ও আমেরিকা: মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রভাব বৃদ্ধির সাথে সাথে বিবাহবিচ্ছেদ খুব শীঘ্রই আরও সাধারণ ও সস্তা হয়ে ওঠে। এসময় বিবাহবিচ্ছেদের জন্য আরও নতুন নতুন কারণ যুক্ত হয়, যেমন: মানসিক রোগ, দীর্ঘমেয়াদী কারাবাস, নির্মমতা এবং পরিত্যাগ। এই নিয়মকে বলা হয় ‘১৯৩৭ খ্রীষ্টাব্দে স্থাপিত Matrimonial Causes Act’।
  • দেখা যায় যে সেই সময়ে, বিবাহবিচ্ছেদ সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে প্রায়ই পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে ব্যভিচার ঘটানো হত। এর প্রতিরোধে ১৯৬৭ খ্রীষ্টাব্দে ‘বিবাহের অপরিবর্তনীয় ভাঙ্গন’ (irretrievable breakdown of marriage) ধারণাটি ‘বৈবাহিক অপরাধ’ ধারণার পরিবর্তে প্রস্তাবিত ও অনুমোদিত হয়। ‘বিবাহের অপরিবর্তনীয় ভাঙ্গন’ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছিল: ব্যভিচার, অসহনীয় আচরণ, দুই বছরের জন্য পৃথক থাকা অথবা একটি পক্ষ বিবাহবিচ্ছেদ না চাইলে তবে পাঁচ বছরের জন্য পৃথক থাকা বা আলাদা বাস করা।
  • ১৯৯৬ খ্রীষ্টাব্দে ‘বিবাহের অপরিবর্তনীয় ভাঙ্গন’-এর প্রমাণ আরো সহজ করা হয়। এ সময়ে ‘বাধ্যতামূলক পরামর্শ’ এবং ‘শান্ত ও স্থির মস্তিস্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়সীমা’ স্থাপন করা হয়, কিন্তু তা কার্যকারী না হওয়ায় আইনটি পরবর্তীতে বাতিল করা হয়।
  • এমন কোন যুগ নেই যেখানে স্বামী-স্ত্রীর একত্রে বসবাস করার বিষয় কঠিন ছিল না। এটি শুধুমাত্র আইনগত জটিলতা, ধর্মীয় বাধা এবং অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারণে বিবাহবিচ্ছেদ থেকে তাদের বিরত রেখেছিল। যীশু আমাদের কঠোর হৃদয়বান না হতে এবং বিবাহবিচ্ছেদের পরিবর্তে ক্ষমা করতে বলেন, যেন বিবাহ ভেঙ্গে না যায়। পৌল ও যীশু উভয়েই বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে কিছু গ্রহণযোগ্য কারণ সমর্থন করতেন, কিন্তু “যে কোন কারণে” বিবাহবিচ্ছেদ তারা বৈধ হিসাবে অনুমোদিত করেন না।

বাইবেলীয় লেখাসমূহের আধুনিক পুনঃব্যাখ্যা

আজকের যুগে কোন কোন কারণে বিবাহবিচ্ছেদ অনুমোদিত?
  • ১) দু’টি কারণ: ব্যভিচার ও পরিত্যাগ।
  • ২) কোন কারণ নেই, বিবাহবিচ্ছেদ নিষিদ্ধ।
  • ৩) চারটি গ্রহণযোগ্য কারণের পাশাপাশি বাইবেলে আরও কারণ নির্দেশিত।
  • ৪) বিবাহবিচ্ছেদ সংস্কৃতির উপর নির্ভরশীল, অর্থাৎ তা সংস্কৃতির সাথে পরিবর্তিত হয়।
  • ইনস্টন-ব্রূয়ার অনুসারে চারটি গ্রহণযোগ্য কারণ হল: ব্যভিচার, পরিত্যাগ, বস্তুগত অবহেলা ও মানসিক বা আবেগীয় অবহেলা।
বিবাহবিচ্ছেদ ও পুনর্বিবাহ সম্বন্ধে পৌলের যোগ দেওয়া বিষয়গুলো কি কি?
  • ১) অবিশ্বাসী দ্বারা পরিত্যাগ।
  • ২) একজন অবিশ্বাসী অথবা একজন অননুতপ্ত বিশ্বাসী দ্বারা পরিত্যাগ
  • ৩) যে কোনো আচরণ যা বিবাহ সামনের দিকে অগ্রসরের জন্য সহায়ক নয়।
  • ৪) ইনস্টন-ব্রূয়ার: একজন অবিশ্বাসী বা বিশ্বাসী দ্বারা পরিত্যাগ
কোন ক্ষেত্রে পুনরায় বিবাহ অনুমোদিত?
  • ১) বিবাহিত স্বামী বা স্ত্রীর কোন একজন মারা গেলে।
  • ২) বিবাহিত স্বামী বা স্ত্রী মারা গেলে বা ব্যভিচার করলে ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌(মার্টিন লুথার)।
  • ৩) এরাস্মুস, ইনস্টন-ব্রূয়ার: মৃত্যুর পরে বা যে কোন আইনগত বিবাহবিচ্ছেদের পরে পুনরায় বিবাহ অনুমোদিত।
  • ৪) যিনি বিবাহবিচ্ছেদের কারণ, তার ক্ষেত্রে পুনর্বিবাহ নিষিদ্ধ। যার বিরুদ্ধে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটানো হয়েছে, অর্থাৎ যিনি বিবাহবিচ্ছেদের কারণ নন, তার ক্ষেত্রে পুনর্বিবাহ অনুমোদিত।
  • ৫) বিবাহবিচ্ছেদের পরে ব্যভিচার করলে, তাকে পুনর্বিবাহ করা নিষিদ্ধ।
নতুন নিয়ম কি পুরাতন নিয়মের ব্যাখ্যার সাথে একমত? যীশুর সময়ের যিহূদী চিন্তার সাথে একমত?
  • ১) নতুন নিয়মের শিক্ষা পুরাতন নিয়ম এবং ঐসময়ের যিহূদী চিন্তা থেকে ভিন্ন।
  • ২) নতুন নিয়মের শিক্ষা পুরাতন নিয়মের আইন-কানুন সমর্থন করে।
  • ৩) নতুন নিয়মের শিক্ষা পুরাতন নিয়মের আইন-কানুন এবং কিছু যিহূদী ঐতিহ্যের সাথে একমত।
  • ৪) ইনস্টন-ব্রূয়ার: নতুন নিয়মের শিক্ষা পুরাতন নিয়মের আইন-কানুন এবং কিছু যিহূদী ঐতিহ্যের সাথে একমত। তা সেই সময়ের সংস্কৃতির জন্য লেখা হয়েছে।
বিবাহবিচ্ছেদের বিষয়ে নতুন নিয়মের মূল শিক্ষা কি?
  • ১) বিশ্বাসী হিসাবে বিবাহবিচ্ছেদ করা কখনও ঠিক নয়। অর্থাৎ, ধর্মান্তরিত বিশ্বাসী অবিশ্বাসী সঙ্গীকে বিবাহবিচ্ছেদ না করুক।
  • ২) বিবাহবিচ্ছেদ শুধুমাত্র দু’টি কারণে অনুমোদিত: ব্যভিচার ও পরিত্যাগ।
  • ৩) বিশ্বাসী হিসাবে বিবাহবিচ্ছেদের কারণ যেন না হই।
  • ৪) ইনস্টন-ব্রূয়ার: বিবাহবিচ্ছেদের কারণ হওয়া উচিত নয়, বরং এটি এড়িয়ে চলা উচিত। বিবাহবিচ্ছেদ পুরাতন নিয়মের মাত্র ৪টি কারণে অনুমোদিত।

বিবাহবিচ্ছেদ ও পুনর্বিবাহ সম্বন্ধে ইনস্টন-ব্রূয়ারের সারাংশ

  • বিবাহবিচ্ছেদের পরে পুনর্বিবাহ বিষয়ক নতুন নিয়মের শিক্ষা প্রকৃতপক্ষে অস্পষ্ট এবং অপরিষ্কার।
  • তবুও যীশুর সময়ে যিহূদী, গ্রীক ও রোমীয় সমাজে বিবাহবিচ্ছেদ ও পুনর্বিবাহ একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার হিসাবে প্রচলিত ছিল।
  • তাই এর বিপরীত কোন চিন্তা বা মতবাদ বিস্তার করতে হলে নতুন নিয়মের লেখকদের অত্যন্ত স্পষ্টভাবে ও অসংশয়ভাবে তা প্রকাশ করতে হত। তাই নতুন নিয়মের লেখকেরা জানতেন যে, তাদের শিক্ষাকে অত্যন্ত স্পষ্ট এবং অসংশয়ভাবে প্রকাশ করতে হবে যদি তারা এই সাধারণভাবে গৃহীত দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীত শিক্ষাদান করতে চান।
  • ইনস্টন-ব্রূয়ার: মোশির আইন-কানুনের ৪টি গ্রহণযোগ্য কারণ যীশু এবং পৌল উভয়েই বিবাহবিচ্ছেদের বৈধ কারণ হিসাবে অনুমোদিত করেন (ব্যভিচার, খাবার, পোশাক, সহবাসের অবহেলা)। আইনগত বা বৈধ বিবাহবিচ্ছেদের পরে তারা পুনর্বিবাহের অনুমোদন দেন। যদিও তারা অতি জোরের সাথে গুরুত্ব দিয়ে বলেন যে, বিবাহবিচ্ছেদ এড়িয়ে চলা উচিত এবং যতদূর সম্ভব এর প্রতিরোধ করা দরকার। তারা উভয়েই বিশ্বাসীদের অনুপ্রেরণা দেন যেন তারা ক্ষমা করে পুনর্মিলনের জন্য অত্যন্ত চেষ্টা করে। তবুও তারা মোশির আইন-কানুন অনুসারে, ৪টি গ্রহণযোগ্য কারণ বিবাহবিচ্ছেদের বৈধ কারণ হিসাবে অনুমোদন অব্যাহত রাখেন। কিন্তু তারা হিল্লেলীয় ‘যে কোন কারণে’ বিবাহবিচ্ছেদ এবং গ্রীক ও রোমীয় সংস্কৃতির বিবাহবিচ্ছেদ সম্বন্ধীয় প্রচলন প্রত্যাখ্যান ও অগ্রাহ্য করেন।
শেষ মন্তব্য
  • আমাদের বিভিন্ন বাইবেলীয় মূল্যবোধগুলো সম্বনয় করতে হবে এবং ভারসাম্য ধরে রাখতে হবে। এখানে প্রধানত দু’টি মূল্যবোধ সমানভাবে জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ: বিবাহের সুরক্ষা <=> ব্যক্তির নিরাপত্তা ও জীবন সুরক্ষা। ঈশ্বর উভয় মূল্যবোধকে গুরুত্ব দেন, উভয়ই রক্ষা করা জরুরী এবং উভয়ই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
  • পশ্চিমা দেশে: স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের জন্য অতি সহজ ও সরল একটি বিষয় হল ‘বিবাহবিচ্ছেদ’। এর পিছনে প্রচলিত মিথ্যা বিশ্বাস ও চিন্তা হল: বৈবাহিক জীবন ‌ভালভাবে পরিচালিত না হলে তবে ভুল ব্যক্তিকে বিবাহ করেছি, তাই আবার নতুন বিবাহ করতে চেষ্টা করার অধিকার আছে।
  • অনেকবার দ্বিতীয় বা তারও বেশি প্রচেষ্টার বিয়েও যে আরো ভাল হয়, এমন নয়। দেখা যায় যে প্রায়ই আগের বিবাহিত জীবনের সমস্যা থেকে কিছু শেখা হয় নি, সঠিক পরামর্শ নেওয়া হয় নি, আগের আঘাত থেকে সুস্থ হয় নি, বিরোধ এড়িয়ে যাওয়া এবং শেষে আগের বিবাহিত সঙ্গীর মত কাউকে পুনরায় বিবাহ করা।
  • আগে আরো রক্ষণশীল সংস্কৃতিতে তুলনামূলকভাবে বিবাহবিচ্ছেদের হার কম ছিল, এর কারণ কি? আগের সংস্কৃতি কি আরো ভাল ছিল? প্রকৃতপক্ষে, রক্ষণশীল সমাজে বিবাহবিচ্ছেদের হার কম থাকার কারণ হল: সামাজিক চাপ, পারিবারিক চাপ, ধর্মীয় চাপ, অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা বা নারীদের কম আর্থিক স্বাধীনতা বা কোনো উপায় নেই বলে। যেখানে বিবাহবিচ্ছেদের হার কম, সেখানে প্রায়ই নারীদের অধিক মূল্য দিতে হত এবং এমন কি তা বর্তমানেও দেখা যায়।